মোঃ নাজমুল ইসলাম,কুলাউড়া
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী মুরইছড়া চা বাগানের বাসিন্দা অনিল সাওতাল ও গৃহিনী সনচড়িয়া সাওতালের একমাত্র সন্তান গোপাল সাওতাল। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুটি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে বা বসতে পারে না। বসিয়ে রাখলে সে ভাঁজ হয়ে পড়ে থাকে। তাই খাওয়ানো ও অন্যান্য পরিচর্যার জন্য মা সনচড়িয়া সাওতাল প্রায় বছর খানেক আগে ঘরের মেঝেতে ছোট একটা আড়াই ফুট গভীর গোলাকার গর্ত করেছেন।
প্রায় আড়াই ফুট গভীর সেই গর্তে শিশু সন্তান গোপালকে ঢুকিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। শিশুটির মাথা ও হাত দুটি যাতে বাইরে থাকে এমন করে গর্তটি করা হয়েছে। ক্ষুধার সময় প্রচণ্ড কান্নাকাটি করলে মা শিশুটিকে গর্তে ঢুকিয়ে খাওয়ান। দিনের বেশিরভাগ সময় কান্না করলে তাকে ওই গর্তের ভেতরে রেখে বিভিন্ন বিনোদন দেখিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করেন মা।
আর এ কাজে সহযোগিতা করেন গোপালের দাদী কল্পনা সাওতাল। মা সনচড়িয়া সাওতাল ঘরের কাজ সামলানোর পাশাপাশি সারাক্ষণ ছেলেকে দেখে রাখেন। বাবা অনিল সাওতাল মুরইছড়া চা বাগানে ১৭০ টাকা মজুরীতে কাজ করেন। অভাব-অনটনের সংসারে সন্তানের চিকিৎসা করানো তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। জরাজীর্ণ একটি ঘরে তাদের কোনোমতে বসবাস।
অভাব-অনটনের সংসারে জন্ম নিলেও গোপাল সাওতালকে নিয়ে মা-বাবার অনেক স্বপ্ন। স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যতার কাছে সেই স্বপ্ন থমকে যাচ্ছে তাদের। তাদের স্বপ্ন, সবার সহযোগিতায় তাদের সন্তান যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করবে।
কর্মধা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী মুরইছড়া চা বাগানের স্কুল টিলা এলাকায় গেলে ঘরের ভেতর এমন একটা হৃদয় নিংড়ানো দৃশ্য প্রতিয়মান হয়। জরাজীর্ণ ঘরে কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে প্রতিবন্ধী শিশু গোপালকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তার পিতা অনিল সাওতাল, মা সনচড়িয়া সাওতাল ও দাদি কল্পনা সাওতাল।
আলাপকালে শিশু সন্তান গোপাল সাওতালের মা সনচড়িয়া সাওতাল জানান, জন্ম থেকেই তার সন্তান শারীরিক, বুদ্ধি, বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। শিশুটির চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি সিলেটের খাদিমনগরের একটি সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানকার চিকিৎসক বলেছেন শিশুটিকে নিয়মিত ফিজিওথেরাপি দিতে হবে। এটাই তার উন্নতির একমাত্র পথ। কিন্তু এ ধরনের থেরাপি নিয়মিত নেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই তাদের।
তিনি বলেন, ছেলেটির কান্না আর কষ্ট আমি কি করে সহ্য করি। তাই বাচ্চাকে শান্ত রাখার জন্য আড়াই ফুট গভীর এই গর্তটি করেছি। সেখানে ঢুকালে ছেলেটি একটু দাঁড়াতে পারে। আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। একমাত্র স্বামী বাগানে শ্রমিকের কাজ করে আমাদের জোড়াতালির সংসার চালাচ্ছেন। সামর্থ্য থাকলে যন্ত্রপাতি কিনে আনতাম শিশুর জন্য। শুনেছি এইরকম প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্য নাকি ডিজাইন করা অনেক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়। সরকার ও সমাজের বিত্তমানদের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, সবার সহযোগিতায় আমার শিশু ছেলেকে উন্নত চিকিৎসা করাতে চাই। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন যেন সে সমাজের অন্যান্য বাচ্চাদের মতো সুস্থভাবে বেঁচে থাকে।
কুলাউড়ার অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিক সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, অনিল ও সনচড়িয়া সাওতালেল একমাত্র শিশু সন্তানটি যেন একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, নিজের মতো করে হাঁটতে পারে এটাই একমাত্র চাওয়া তার বাবা-মায়ের এবং আমাদের সমাজের সবার। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর পরিবারে প্রতিবন্ধী ছোট্ট শিশুটি বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকবে সেটা কারো কাম্য হতে পারে না। তার চিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় ছাড়াও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
এবিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচও) ডা. জাকির হোসেন বলেন, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন গোপাল জন্মগতভাবে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় তার এই অবস্থা। পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিশুটি জন্ম বাড়িতেই হয়। বর্তমানে সাড়ে তিনবছর হয়ে গেলেও কথা না বলেতে পারা ও কোনো কিছু জানাতে না পারার সমস্যা রয়েছে। উন্নত চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপীর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে শিশুটির পরিবারকে।
এব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, বিষয়টি খুবই মানবিক। প্রতিবন্ধী শিশু গোপাল সাওতালের খোঁজ নিয়েছি। তাকে সমাজসেবা মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে ভাতা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তাও করা হবে।
ক্যাপশন: কুলাউড়ায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু গোপাল সাওতালকে আড়াই ফুট গর্তে রেখে পরিচর্চা করছেন মা ও দাদি।
Leave a Reply