একুশে সিলেট ডেস্ক
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় অনেক ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ও কালভার্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় আগে লক্ষ্মীপুর-হাসিমপুর সড়কে ফানাই নদীর ওপর নির্মাণ করা পাকা সেতুটি অন্যতম। বর্তমানে ওই সেতুটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এদিকে কর্মধা ইউনিয়নের রাঙ্গিছড়া এলাকায় এক পরিবারের লোকদের চলাচলের সুবিধার্থে নতুন একটি সেতু নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
এই খবরে স্থানীয় ১০-১৫টি গ্রামের মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
চলমান সেতুর কাজ বন্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতু পুনর্নির্মাণের দাবিতে গত ৩১ অক্টোবর কুলাউড়া সদর ইউনিয়ন ও কর্মধা ইউনিয়নের প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ স্বাক্ষরিত একটি লিখিত আবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে জমা দিয়েছে।
লিখিত আবেদন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর-হাসিমপুর সড়কে ফানাই নদীর ওপর তিন বছর ধরে একটি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, যেখানে স্থানীয় লোকজন মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। ২০১৮ সালে কুলাউড়া আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের নির্দেশে কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ইউপি সদস্য নরসামলু রাজভর (ছমি বাবু)-এর বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় চলাচলের জন্য স্থানীয় দেওছড়ার ওপর প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়।
যদিও সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে, কিন্তু কাজ শুরু হয়নি।
পরবর্তীতে ছমি বাবুর ছেলে কর্মধা ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক গোপাল রাজভর আওয়ামী লীগের শাসনামলে সাবেক এমপি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার প্রভাবে কাজটি শুরু করতে নানা তৎপরতা চালান। চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে সেতুটির টেন্ডার হওয়ার পর ছমি বাবুর বাড়ির সামনে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়, যা স্থানীয় এলাকার লোকজনের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। স্থানীয়রা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, যদি ওই সেতুর কাজ বন্ধ না করে লক্ষ্মীপুর-হাসিমপুর সড়কে ফানাই নদীর ওপর নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ সেতু পুনর্নির্মাণ করা না হয়, তবে তারা কঠোর আন্দোলন শুরু করবে।
সূত্র আরো জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ফানাই নদী খননের সময় অতিবৃষ্টির কারণে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামলে ওই সেতুর মধ্যবর্তী স্থান দেবে যায়। একই সময়ে সেতুর পূর্ব পাশে রাঙ্গিছড়া-লক্ষ্মীপুর-গুতগুতি সড়কের প্রায় ২০০ ফুট জায়গা ধসে পড়ে। গত বন্যায়ও সেতুটি ফের ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। এ অবস্থায়, সেতুসহ ওই সড়ক দিয়ে মরণঝুঁকি নিয়ে যানবাহন ও লোকজন চলাচল করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে এলজিইডির উদ্যোগে প্রায় ২৪ মিটার দীর্ঘ পাকা ওই সেতুটি নির্মাণ করা হয়।
লক্ষ্মীপুর-হাসিমপুর সড়কের ফানাই নদীর ওপর ওই সেতু দিয়ে কর্মধা ইউনিয়নের হাসিমপুর, বেড়ী, গুতুমপুর, রাঙ্গিছড়া, কুলাউড়া সদর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর, প্রতাবী, গুতগুতি, পৃথিমপাশা ইউনিয়নের পুরশাই, ভাটগাঁও ও দেওগাঁও, এবং রাউতগাঁও ইউনিয়নের নর্তন, কবিরাজী ও পালগ্রামের অন্তত ৪০ হাজার লোক প্রতিদিন বিভিন্ন কাজে কর্মধা ইউনিয়নের রাঙ্গিছড়া বাজারে চলাচল করে। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর, গুতগুতি ও প্রতাবী এলাকার শিক্ষার্থীরা সেতুর ওই পারে কর্মধা ইউনিয়নের বাবনিয়া হাসিমপুর নিজামিয়া দাখিল মাদরাসায় গিয়ে পড়ালেখা করে। অন্যদিকে বাবনিয়া, গুতুমপুর, বেড়ীসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার শিক্ষার্থীরা সেতুর এপারে লক্ষ্মীপুর মিশন ও অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ালেখা করে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেবে যাওয়া সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় লোকজন সতর্কভাবে সেতু পারাপার হচ্ছে। সীমিত পরিসরে ওই সড়ক দিয়ে একইভাবে ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ছোট যানবাহনও চলাচল করছে। যেকোনো মুহূর্তে সেতুটি ভেঙে নদীতে পড়ে যাবে, এতে বন্ধ হয়ে যাবে সবধরনের চলাচল। গত অক্টোবর মাসে ওই ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে দুর্ঘটনায় স্থানীয় হাসিমপুর গ্রামের বাসিন্দা হাজী আব্দুল্লাহ (৬০) ও রাঙ্গিছড়া বাজারের ব্যবসায়ী হাসিম মহাজন (৫৮) নামে একই পরিবারের দুই ভাই মারা যান। সেতু নির্মাণ না হওয়ায় স্থানীয়দের এখন মৃত্যু আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
কর্মধা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হেলাল আহমদ, লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক আলাউদ্দিন কবির, সমাজকর্মী রাহেল আহমদ, জুবের হান্নান, বাবুল আহমদসহ অন্তত ২০-২৫ জন মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে জানায়, ফানাই নদীর ওপর ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটি নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিকবার আবেদন করেছি। এলজিইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা অনেকবার সেতুটি পরিদর্শন করে দ্রুত নির্মাণের আশ্বাস দিলেও সেতুটি নির্মাণে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এদিকে জনগুরুত্বপূর্ণ সেতুটি রেখে রাঙ্গিছড়া এলাকায় ছমি বাবুর পরিবারের ১৫-২০ জন লোক চলাচলের সুবিধার্থে নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল সরেজমিনে সেতু নির্মাণের সম্ভাবনা যাচাই করে মানুষের উপকারে আসে এমন সেতু নির্মাণ করা।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শিমুল আলী জানান, তৎকালীন এমপি সুলতান মনসুর মহোদয়ের সময়কালে প্রথমে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে গার্ডার সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে এখন ১ কোটি টাকার কাজ হবে না। বর্তমানে ওই প্রস্তাবটি সংশোধন করে ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৮ ফুট দৈর্ঘ্যের বক্স কালভার্ট করার জন্য উর্ধ্বতন দপ্তরে চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে।
এলজিইডি’র মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহমেদ আব্দুল্লাহ জানান, তিনি সরেজমিনে ওই ঝুঁকিপূর্ণ সেতু ও সড়কটি পরিদর্শন করে সেতু নির্মাণের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। অনুমোদন হলে নতুন করে সেতু তৈরি করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে লিখিত একটি অভিযোগ পেয়েছি। সরেজমিনে পরিদর্শন করে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
Leave a Reply