আন্তজার্তিক ডেস্ক
অতি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে আকস্মিক বন্যায় পাকিস্তান, ভারতশাসিত কাশ্মীর ও নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এখনও অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন।
পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৩২১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ শনিবার জানিয়েছে। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বুনের অঞ্চলের দশটিরও বেশি গ্রাম আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বুনের এলাকায় ধসে যাওয়া সড়ক ও ভূমিধসের কারণে জরুরি উদ্ধারকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে পৌঁছাতে পারছেন না। উদ্ধার সংস্থা ‘রেসকিউ ১২২’-এর মুখপাত্র বিলাল ফায়েজি জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও অনেক মানুষের চাপা পড়ে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
উদ্ধার সংস্থা রেসকিউ ১২২-এর মুখপাত্র বিলাল ফায়েজি সিএনএনকে বলেন, ‘এলাকা থেকে এখন পর্যন্ত ১২০টিরও বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কয়েক দিন আগেও এখানে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এক বসতি ছিল। এখন এখানে শুধু বড় বড় পাথরের স্তূপ আর ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে।’
এদিকে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে ত্রাণ তৎপরতায় নিয়োজিত একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে পাঁচজন ক্রু সদস্য মারা গেছেন বলে স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
ভারতশাসিত কাশ্মীরের চাশোটি শহরে শুক্রবার কমপক্ষে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ২০০ জনের বেশি নিখোঁজ রয়েছেন। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় এই স্থানের ব্যাপারে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
নেপালে কমপক্ষে ৪১ জন নিহত এবং আরও ১২১ জন আহত হয়েছেন বলে দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ রয়টার্সকে জানিয়েছে।
উত্তর পাকিস্তানের মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল সালারজাইয়ের এক শিক্ষার্থী ফারহাদ আলী বলেন, ‘বৃষ্টি যখন আরও তীব্র হলো, তখন অল্প সময়ের মধ্যেই মনে হলো যেন ভূমিকম্প হচ্ছে—পুরো মাটি কাঁপছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে আমার পুরো পরিবার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে। আমরা দেখি আমাদের বাড়ির পাশের খালের মধ্যে কাদামাটির ঢল আর বিশাল বড় বড় পাথর গড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছিল কেয়ামত নেমে এসেছে, পৃথিবীর শেষের মতো দৃশ্য।’
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রবল বর্ষণ, ভয়াবহ ভূমিধস ও প্রাণঘাতী বন্যার পানিতে অঞ্চলটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জুনের শুরুর দিক থেকে শুরু হওয়া অস্বাভাবিক ভারী বৃষ্টি পুরো পাড়া-মহল্লা ধুয়ে নিয়ে গেছে এবং অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
পাকিস্তানের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে রোববার থেকে বৃষ্টি আরও বাড়বে। এ কারণে হঠাৎ বন্যা ও শহুরে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, কাদামাটিতে ভরা বিশাল পানির স্রোত প্রদেশটির ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের পর্যটন এলাকা এড়িয়ে চলতে এবং বন্যার সময় কোনো অবস্থাতেই নদী পার না হতে সতর্ক করেছে।
অন্যদিকে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, বুধবারের প্রবল বর্ষণ আসলে একটি ‘ক্লাউডবার্স্ট’-এর কারণে হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় এক ঘণ্টার মধ্যে ১০০ মিলিমিটারের (৪ ইঞ্চি) বেশি বৃষ্টি ঝরে পড়ে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু সংকট এ বছর হিমালয়ে মৌসুমি বন্যার তীব্রতা ও ঘনত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, সড়কগুলো রূপ নিয়েছে উত্তাল নদীতে। প্রবল বর্ষণে ভারতশাসিত কাশ্মীরে বহু ভবন ধসে পড়েছে এবং গাড়ি ভেসে গেছে।
একটি ভিডিওতে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে পানি, কাদামাটি ও ধ্বংসাবশেষের বিশাল প্রাচীর নেমে আসতে দেখা গেছে।
সারা অঞ্চলে জোরেশোরে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা, নিখোঁজদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। উদ্ধার হওয়া কয়েকজনকে ইতোমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ শুক্রবার রাজধানী ইসলামাবাদে ‘ক্লাউডবার্স্ট’ এবং পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে এক জরুরি বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন।
‘সহ্য করার মতো দৃশ্য নয়’
ভারতশাসিত কাশ্মীরের পার্বত্য এলাকার নীচু ভূখণ্ডে লাশ ভেসে গেছে এবং পুরো সম্প্রদায়ের মিলনস্থলগুলো ভেসে গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন। বেঁচে যাওয়া লোকজন এখনো এই ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা মেনে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
একজন ৭৫ বছর বয়সী গ্রামবাসী বলেন, তিনি যখন কাদার নীচ থেকে আটটি মৃতদেহ টেনে বের করতে দেখেন, তখন চারপাশে কেবল ‘সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপের দৃশ্য’ চোখে পড়ে।
মানবাধিকার কর্মী আবদুল মজিদ বিচু অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, ‘এটি ছিল হৃদয়বিদারক ও সহ্য করার মতো নয়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে তিনটি ঘোড়া জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।’
চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হিমালয় অঞ্চলের একটি পাহাড়ি গ্রামে আকস্মিক বন্যার ঢল নেমে আসে। এতে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়।
জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, শুক্রবার ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে পরিকল্পিত কিছু অনুষ্ঠান তিনি বাতিল করেছেন।
মাছাইল যাত্রা হিন্দুদের একটি জনপ্রিয় তীর্থযাত্রা। ভক্তরা দেবী দুর্গার এক রূপ ‘মাছাইল মাতার’ উচ্চ পার্বত্য মন্দিরে যাত্রা করেন। চাশোটি থেকে ভক্তরা পদযাত্রা শুরু করেন, সেখানেই যানবাহনের রাস্তা শেষ হয়ে যায়, বাকিটুকু পায়ে হেঁটে যেতে হয়।
Leave a Reply