সর্বশেষ :
জুলাই শহীদ সোহাগের পরিবারর সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে প্রতারক দালাল

জুলাই শহীদ সোহাগের পরিবারর সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে প্রতারক দালাল

মোঃ ওয়ালী উল্লাহ সরকার, জামালগঞ্জ

আমার বুকের মানিকটারে গুলি কইরা মারলো…! আর যেই দালালের কারণে সব ছাইড়া ঢাকায় যাইতে হইছিল — তাদের বিচার কই?

জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামের শহীদ সোহাগের মা মোছা: রোকেয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন এসব কথা।

শহীদ সোহাগ (২৩) পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তৃতীয়। একজন গরিব দিনমজুরের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই শান্ত স্বভাবের ছিলেন। ২০১৯ সালে পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাতে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন বুনতে থাকেন। বাবার সাথে আলোচনা করে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ভূরিস্থল গ্রামের দালাল আখলুক মিয়ার কাছে সৌদি আরবে পাঠানোর জন্য দেন ৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছিল বাবার জমানো, বাকিটা সুদে ধার নেওয়া।

কিন্তু সময় গড়ালেও সোহাগের বিদেশ যাওয়া হয়নি। দালাল শুধু সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকে। উপায় না পেয়ে ২০২২ সালে সোহাগসহ পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় পাঠান বাবা আবুল কালাম। বড় ছেলে বিল্লাল, শুভ ও যুবায়ের নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেন, আর সোহাগ যোগ দেন বাড্ডার ‘আশা গার্মেন্টস’-এ।

সবকিছু পাল্টে যায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। শেখ হাসিনার পতনের খবর শুনে সোহাগ বিজয় মিছিলে যোগ দেন। বাড্ডা থানার সামনে মিছিল চলাকালীন সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি।

সোহাগের বড় ভাই বিল্লাল জানান, ঐদিন দুপুরে খেয়ে বাসা ফিরি। ছোট ভাই সোহাগ আর শুভ মা’কে ফাঁকি দিয়ে মিছিলে যায়। শুভ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েও বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু সোহাগ আর ফেরেনি। পরে ফোনে জানতে পারি, গুলিবিদ্ধ সোহাগকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। ইবনে সিনা হাসপাতালে গেলে জানানো হয়, সোহাগ আর বেঁচে নেই।

পরদিন (৬আগষ্ট) জানাজা শেষে সোহাগের মরদেহ গ্রামের বাড়ির পাশে দাফন করা হয়।

শহীদের মা বলেন, “ছেলেদের রোজগারে সংসার চলতো। যা বাঁচতো, পাঠিয়ে দিতাম স্বামীকে ঋণ শোধের জন্য। এখন ঋণ আর দুঃখ— দুইটাই রয়ে গেছে। আমি চাই যারা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরেছে আর যে দালাল আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।

সোহাগের বাবা আবুল কালাম জানান, তিনি একজন খেটে খাওয়া মানুষ। তার নিজস্ব জমি মাত্র ১ শতক। এ জমিতে কোনোভাবেই ঘর তৈরি করা সম্ভব না হওয়ায় তিনি তার ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু জমি চেয়ে নেন। সেখানেই কোনোরকমে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। উপজেলা জামায়েত ইসলামের পক্ষ থেকে ২ বারে প্রায় ২ লক্ষ টাকা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষ থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুদানের চেক, জেলা প্রশাসক মহোদয়ের পক্ষ থেকে গৃহ নির্মাণের জন্য ২ লক্ষ টাকা দিয়েছেন, এছাড়াও জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাধ্যমে ১০ লক্ষ টাকার এফডিআর করা হয়েছে।

ছেলেকে সৌদি আরবে পাঠানোর জন্য নিজের জমানো ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং সুদে ধার করে আরও ৪ লাখ টাকা সংগ্রহ করে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ভূরিস্থল গ্রামের আখলুক মিয়া (যিনি বিদেশ পাঠানোর দালাল হিসেবে পরিচিত) এর হাতে দেন। উদ্দেশ্য ছিল—ছেলে সোহাগকে বিদেশে পাঠানো।

কিন্তু আখলুক মিয়া দীর্ঘ সময় ধরে টালবাহানা করতে থাকেন এবং সোহাগকে বিদেশে পাঠাননি। ফলে উপায় না দেখে ঋণের ভারে জর্জরিত আবুল কালাম তার পরিবারকে ঢাকায় কাজের সন্ধানে পাঠিয়ে দেন। সেখানে জুলাই আন্দোলনের পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। দালালের কাছ থেকে টাকাও পাইনি ছেলেকেও হারালাম। এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।

স্থানীয় বাসিন্দা দিলোয়ার হোসেন বলেন, সোহাগ খুব নম্র ও ভদ্র ছেলে ছিল। মাদ্রাসায় পড়ত। বাবা আবুল কালাম কখনো দিনমজুর, কখনো রিকশা চালিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন। এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় কিছুই করতে পারেন না।

জামায়াতে ইসলামীর উপজেলা নায়েবে আমির ফখরুল আলম চৌধুরী জানান, শহীদ সোহাগের পরিবারকে দলীয় অনুদান হিসেবে ২ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। ঈদুল আজহায় আরও ২০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়। ছাত্র ও সামাজিক সংগঠনগুলোও পাশে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবসময় তাদের খোঁজখবর ও পাশে আছি।

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকীন নূর বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহীদ সোহাগের পরিবারকে ১ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। জেলা পরিষদ থেকে আরও ৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাদের আবাসনের জন্য। জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকার এফডিআর করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, জামালগঞ্জের জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহতদের ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। সরকারি অনুদান পাওয়া মাত্রই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। প্রশাসন সবসময় তাদের পাশে রয়েছে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.




© All rights reserved ©ekusheysylhet.com
Design BY DHAKA-HOST-BD
weeefff