সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনার অভাবে টাঙ্গুয়ার হাওর সবাই মিলে ধ্বংস করছে

সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনার অভাবে টাঙ্গুয়ার হাওর সবাই মিলে ধ্বংস করছে

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

সম্পদ ও সৌন্দর্যে অনন্য সুনামগঞ্জের নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওর ‘সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনার অভাবে আজ অভিভাবকহীন’ বলে মন্তব্য করেছেন আদালত। আদালত আরও মনে করেন, সুন্দরবনের পর জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জলাভূমি হিসেবে রামসার সাইট ঘোষিত এই হাওরকে ‘সবাই মিলে যেমন ইচ্ছা, তেমন ধ্বংস করছে।’

টাঙ্গুয়ার হাওর–সম্পর্কিত এক আদেশে সুনামগঞ্জের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলমগীর এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে হাওরে হাউসবোট চলাচলে কোনো নেতিবাচক প্রভাব আছে কি না, পর্যটনের অবস্থা, কেন হাওরে গাছ, মাছ ও পাখি কমছে, হাওরে কোনো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে কি না, এসব বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে তাহিরপুর থানা–পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।

টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, বিশেষ করে সম্প্রতি সুনামগঞ্জের দুটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এ–সংক্রান্ত সংবাদের প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ করে মোহাম্মদ আলমগীর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গতকাল রোববার (২৭ জুলাই) এই আদেশ দেন। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮–এর ১৯০ (১) (সি) ধারায় আমলে নেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সংবাদগুলো তাঁর নজরে আসায় তিনি এই ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে আদেশে উল্লেখ করেছেন।

বিচারক আদেশে বলেন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে তাঁর মনে হয়েছে, সুন্দরবনের পর জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওরকে রামসার সাইট ঘোষণার পরও সুরক্ষিত ব্যবস্থাপনার অভাবে আজ অভিভাবকহীন। সবাই মিলে যেমন ইচ্ছা, তেমন ধ্বংস করছে। মাছ, গাছ, পাখিসহ জীববৈচিত্র্যের আধার, বিশেষ করে মিঠাপানির মাছের জন্য বিখ্যাত এই হাওরে অবাধ আহরণের কারণে মাছ কমছে। হাওর ভরাট, বন ও আবাসস্থল ধ্বংস, মানুষের উৎপাত ও শিকারের ফলে কমছে পাখির সংখ্যা। যে অভয়ারণ্যে ইঞ্জিনচালিত নৌকা প্রবেশ নিষেধ, সেখানে অবাধে চলছে শতাধিক হাউসবোট। পর্যটকদের অবাধ বিচরণও হাওরের পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই সবার আগে পরিবেশকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আদেশে আরও বলা হয়, টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটনের কারণে স্থানীয় মানুষ কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না; বরং তাঁরা নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। হাওরের সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। আদেশে বিচারক বলেন, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত), বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২, মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০, বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী এখানে অপরাধ সংঘটিত হতে পারে বলে সন্দেহের কারণ আছে, যা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সরকারি নির্দেশনা মেনে টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোট চলাচল করে কি না, হাওরে কতগুলো হাউসবোট আছে, হাউসবোটের মালিকের নাম–ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর, বোট কোন ঘাটে অবস্থান করে, কোন রুট দিয়ে যাতায়াত করে তাসহ হাউসবোটগুলো যথাযথভাবে নিবন্ধিত কি না, সে অনুযায়ী চলে কি না, এগুলো সরকারি কর পরিশোধ করে কি না, তা বিস্তারিত উল্লেখ করে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে জেলার তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সহযোগিতার জন্য তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) নির্দেশ দেওয়া হয়।

একই আদেশে সুনামগঞ্জের দুটি বড় বালুমহাল যাদুকাটা ও ধোপাজান চলতি নদের বিষয়েও তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সিলেটের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আদালতের এই আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নাজির মো. এনামুল হক।

এদিকে নিবন্ধন না থাকায় গতকাল দিনভর হাওরে অভিযান চালিয়ে পর্যটকবাহী ১২টি হাউসবোটকে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কার্যালয়ে ‘হাওরের সুলতান–৪’ নামের একটি হাউসবোট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেবা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ দিয়েছেন ঢাকা থেকে আসা পর্যটক মাহাবুব আলম সোহাগ। এই অভিযোগের শুনানি হবে আগামী ৬ আগস্ট।

প্রশাসনের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় এই হাওরের অবস্থান। হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট–বড় ১০৯টি বিল আছে। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে সরকার। এতে ইজারাদারির অবসান হয়। এরপর ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি ‘রামসার সাইট’ বা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হাওরের জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় হাওরটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তখন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসন টাঙ্গুয়ার হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.




© All rights reserved ©ekusheysylhet.com
Design BY DHAKA-HOST-BD
weeefff