সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
গতকাল সকালে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১০-১৫টি গ্রামের প্রায় ৮-১০ হাজার লোক মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে বিলে নেমে পড়ে।
সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা উপজেলার বিলগুলোতে রীতিমতো মাছ লুটের হিড়িক পড়েছে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে পুলিশের সামনেই হাজার হাজার লোক বিলে নেমে মাছ লুট করে নিচ্ছে। গত ৫ দিনে এই দুই উপজেলার অন্তত ৮টি বিলের মাছ লুট করা হয়েছে। ইজারাদারদের দাবি, এই বিলগুলো থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকার মাছ লুট করে নেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার শাল্লা উপজেলার কাশীপুর শতোয়া বিলের মাছ লুট করে নেওয়া হয়। স্থানীয়রা জানান, বিলের মাছ লুটের ঘোষণা দিয়ে আগের দিন আশপাশের কয়েকটি এলাকায় মাইকিং করা হয়।
জানা যায়, গতকাল সকালে দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১০-১৫টি গ্রামের প্রায় ৮-১০ হাজার লোক মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে বিলে নেমে পড়ে। তারা ইচ্ছেমতো মাছ লুট করে নিয়ে যায়। এসময় বিলের পাড়ে ৮-১০ জন পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা লুটপাটকারীদের বাধা দেয়নি।
একই দিনে উপজেলার কাশীপুর গ্রামের কাছের বাইল্লা বিল ও ইয়ারাবাদ গ্রামের ভাটিগাং বিল লুটপাট করা হয়।
শতোয়া বিলের ইজারাদার উত্তর জারুলিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংগঠন।
মাছ লুটের বর্ণনা দিয়ে এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রজেশ দাস বলেন, ‘এমন পরিস্থিতি জীবনেও দেখিনি। গণহারে লুটপাট চলছে। আমরা প্রতি বছর ৪৫ লাখ টাকা রাজস্ব দেই। তিন বছর অন্তর অন্তর মাছ ধরা হয়। আগামী বছর মাছ ধরার কথা থাকলেও এলাকার ১০-১৫ হাজার মানুষ দুই দিনে আমাদের জলমহালের কোটি টাকার বেশি মাছ লুটে নিয়ে গেছে।’
এই লুটপাট শুরু হয় গত শুক্রবার থেকে। শুক্রবার সকালে দিরাই উপজেলার চরনারচর গ্রামের পাশের কামান-কচমা বিলে জোর করে মাছ ধরে নেয় ৫০০ থেকে ৭০০ মানুষ। পরদিন শনিবার আবারও ৮-১০ হাজার মানুষ বিভিন্ন যানবাহনে করে এসে এই বিলে লুটপাট চালায়।
এরপর থেকে প্রতিদিনই চলছে লুটপাট। কামান-কচমা, শতোয়া, বাইল্লা, ভাটিগাং বিল ছাড়াও এ পর্যন্ত লুট করা হয় শাল্লার জোয়ারিয়া বিল, দিরাইয়ের আতনি বিল, লাইড়া-দিঘা ও চইনপট্টা বিলের মাছ।
দিরাইয়ের কামান-কচমা বিলের ইজারাদার চরনারচর বি. এম. মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক সুধীর বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা সরকারকে প্রতি বছর ৫০ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব দেই। দুই দিনে আমাদের বিলের প্রায় ২ কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে। ১৫-২০ কেজি ওজনের বোয়াল ও আইড় মাছ গাড়ি ভরে নিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, পুলিশের সামনেই জোর করে মাছ নিয়ে গেছে। পুলিশের কিছু করার ছিল না, কারণ পুলিশ ছিল ১০ জন, মাছ ধরতে এসেছিল ৮-১০ হাজার মানুষ।
স্থানীয় লোকজন ও বিলের ইজারাদার জানিয়েছেন, দিরাই-শাল্লা উপজেলার শ্যামারচর, ললোয়ারচর, মাইতি, কার্তিকপুর, নোয়াগাঁও, চিকাডুপি, বল্লভপুর, উজানগাঁও, সোনাকানি, নিজগাঁও, মির্জাপুর, রাহুতলা, শরীফপুর, কাশীপুরসহ আশপাশের গ্রামের লোকজন দিরাই-শাল্লার কামান ও লাইড়া দীঘা জলমহালের মাছ লুটে জড়িত।
মাছ লুটে বাধা দেওয়ায় হামলার ঘটনাও ঘটেছে। লুটপাটে আপত্তি জানানোয় শাল্লার আটগাঁও গ্রামের রনি বিল্লালের বসতঘর ও অটোরিকশা ভাঙচুর করে লুটপাটকারীরা। এছাড়া তার ছোট ভাইয়ের মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রনি বিল্লাল।
তবে লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) জাকির হোসেন বলেন, ‘কয়েকটি বিলের মাছ লুটের অভিযোগ পেয়েছি। লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত শনি ও রবিবার সকালে শাল্লার যাত্রাপুর গ্রামের পাশের জোয়ারিয়া বিলের মাছ জোর করে ধরে নেয় ছব্বিশা, দামপুর, কান্দিগাঁও, ইয়ারাবাদ, কান্দকলা, রঘুনাথপুর, যাত্রাপুর গ্রামের হাজারখানেক লোক। বিলের পাহারাদাররা জলমহালে থাকলেও লুটপাটকারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা নীরব ছিলেন।
জোয়ারিয়া বিলের ইজারাদার যাত্রাপুর হিলিপ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি হিমাদ্রী সরকার বলেন, ‘বিলে বাঁশ-কাঠা দেওয়া, পাহারাদার রাখাসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আগামী বছর মাছ ধরার কথা ছিল কিন্তু দুই দিন জোর করে মাছ ধরে আমাদের অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘হাজারখানেক লোক এসে মাছ ধরে নিয়ে গেছে। তারা কেন এমনটি করলো তা বুঝতে পারছি না। কারো সাথে আমাদের কোনো বিরোধও নেই।’
রবিবার সকালে দিরাই উপজেলার মেঘনা-বারঘর জলমহালের একটি বিল ও একই উপজেলার আতনি বিল (শাল্লা উপজেলার জয়পুর গ্রামের সামনে) জোর করে মাছ ধরে নেয় বিলের আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ। এরপর সোমবার দিরাই উপজেলার কাশীপুর লাইড়া দীঘা গ্রুপ ফিশারীর এলংজুরি ও আলীপুর গ্রামের পেছনের লাইড়া-দীঘা ও চইনপট্টা বিলের পাইলের (অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে মাছ বড় করা) প্রায় কোটি টাকার মাছ ধরে নেয় বিলের আশপাশ এলাকার ৮-১০ হাজার মানুষ।
মাছ লুটের বিষয়ে দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মেঘনা ও কামান বিলের মাছ ধরা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে শুনেছি। এলাকার লোকজন কিছু বিলের মাছ ধরেছে। লাইড়া দীঘা গ্রুপ ফিশারীর পাইলের অংশে জোর করে মাছ ধরার অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জোয়ারিয়া বিলে মাছ ধরার খবর পেয়ে পুলিশ পাঠিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার লোক ভোরে মাছ ধরতে যায়। এসব বিল থানা থেকে অনেক দূরে, তাই পুলিশ যাওয়ার আগেই লোকজন চলে যায়।’
এ ব্যাপারে জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘দিরাইয়ের একটি জলমহাল থেকে জোর করে মাছ ধরে নেওয়ার অভিযোগ পেয়েছি। এছাড়াও আর কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হবে।’
Leave a Reply