সম্পাদকীয়
বছর ঘুরে আবার এলো পহেলা বৈশাখ, যা কিছু জীর্ণ-পুরোনো, অশুভ ও অসুন্দর, তা পেছনে ফেলে নতুনের কেতন উড়িয়ে বাঙালি বরণ করে এদিন। শুরু হলো আরও একটি নতুন বছর—১৪৩২ বঙ্গাব্দ। কালবেলার পক্ষ থেকে পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ীসহ সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এ অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। অন্যায়-অন্যায্য শাসনকে ন্যায্যতা দিতে ধর্মের অপব্যবহার এ ভূখণ্ডের বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে; দিয়েছে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত মোগল সম্রাট আকবরের সময় থেকে। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে। শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে বাংলা নববর্ষ।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই এক অর্থনৈতিক ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাদের পুরোনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তারা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। এটি আজও পালিত হয়। তবে ঐতিহ্য রক্ষার্থে। কেননা প্রযুক্তির উৎকর্ষে তা হয়ে উঠেছে কম্পিউটারনির্ভর।
নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাধারণত নববর্ষে তারা বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং পূত-পবিত্র হয়। ভালো খাওয়া, ভালো পরতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করেন। ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। বাংলা নববর্ষ পালনের এ সময়ে দেশে উদযাপিত হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈসাবি—বৈসু, সাংগ্রাই, বিজুসহ প্রভৃতি উৎসব। চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখের নানা আয়োজন চলে পাহাড়ি নানা গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে। নিজেদের বর্ষবরণ উৎসবের পাশাপাশি অন্যদের এসব উৎসবের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। এটি শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা যখন নববর্ষ উদযাপন করছি, এ সময়টায় পুরো পৃথিবীতে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা। সে অস্থিরতা রয়েছে যুদ্ধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের গাজায়। অস্থিরতা রয়েছে মার্কিন দেশের সদ্য আরোপিত শুল্কনীতি ঘিরে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে। একই সঙ্গে আমাদের দেশও পার করছে একটি ক্রান্তিকাল। নতুন বর্ষে পদার্পণের মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বের এ অস্থিরতা দূর হবে—এ চাওয়া সবার।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে দেশের মানুষকে। সাংস্কৃতিক চেতনার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজের সর্বস্তরে। অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু সত্য, বাঙালির নববর্ষ কখনোই সব বাঙালির কাছে সমানভাবে আসেনি। কারও কাছে এসেছে খরা হয়ে, খাজনা দেওয়ার সময় হিসেবে, মহাজনের সুদরূপে। এটি পীড়াদায়ক। সামাজিক-সংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি বিধায়ই এ বৈষম্যের পরিখা গভীর ও প্রশস্ত হচ্ছে। তবে পহেলা বৈশাখ বৈষম্যের দেয়াল ভাঙার কথা বলে; গড়তে, তুলতে বলে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব। নতুন বছর শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা বয়ে আনুক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে সুর মিলিয়ে বলি—বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। শুভ নববর্ষ।
Leave a Reply