একুশে সিলেট ডেস্ক
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি পাহাড়ি অরণ্যের ভেতর ছোট্ট একটি গ্রাম ত্রিপুরাপল্লি। শতবর্ষ আগে গড়ে ওঠা এ বসতিতে এক সময় বাস করত কয়েক ডজন আদিবাসী পরিবার। সম্প্রতি মাটি ও বালু লুটের প্রবণতা বাড়ায় প্রবল হয়েছে ভূমিধসের শঙ্কা।
এই অঞ্চলে ভূমিধসের আতঙ্ক নিয়ে মাত্র ১৯টি পরিবার বসবাস করছে। গ্রামের একমাত্র সড়ক ভেঙে পড়ার পথে। স্কুলে যাওয়া-আসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে নিতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে। স্থানীয়দের অভিযোগ, একসময় নিয়ন্ত্রণহীন বালু-পাথর উত্তোলন পাহাড়ের গঠন দুর্বল করে দিয়েছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এ পল্লি মুছে যাবে মানচিত্র থেকে।
শতবর্ষের গ্রাম ধ্বংসের পথে
৯০ বছর বয়সী মঙ্গেশ্বর দেববর্মা বলেন, সাতছড়ি গ্রাম এক সময় ছিল ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ। শত শত পরিবার ছিল এখানে। এখন মাত্র ১৯টি পরিবার টিকে আছে। প্রতিদিন ভয়ে থাকেন, কখন তাদের ঘর মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তিনি জানান, গত কয়েক বছরে অন্তত ৩০টি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে একের পর এক টিলা ধসে বহু মানুষের ভিটামাটি বিলীন হয়ে গেছে।
গ্রামপ্রধান চিত্তরঞ্জন দেববর্মা জানান, ‘মাত্র ছয় মাস আগেই পাহাড়ধসে পাঁচ পরিবার ঘরহীন হয়েছে। আমরা বুঝে উঠতে পারছি না কত দ্রুত মাটি হারিয়ে যাচ্ছে।’
সেতু ভেঙে চলাচল ব্যাহত
ত্রিপুরাপল্লির ভেতর দিয়ে যাওয়া একমাত্র সেতুটি ২০২২ সালে ধসে পড়েছে। এরপর থেকে গ্রামবাসী কার্যত অবরুদ্ধ। বন ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি সঞ্জুক্তা দেববর্মা বলেন, সেতুটি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে জরুরি সময়ে চিকিৎসা বা স্কুলে যাতায়াতে খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বহুবার আবেদন করেও সমাধান পাননি।
স্থানীয় সজল দেববর্মা জানান, বর্ষায় শিশুদের স্কুলে পাঠানো যায় না। অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে।
অবৈধ বালু উত্তোলনে দুর্বল হচ্ছে পাহাড়
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, এক সময় পল্লি এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে পাহাড় দুর্বল হয়ে গেছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, সেই সঙ্গে হুমকির মুখে পড়ছে আদিবাসী পরিবারগুলোর জীবন। অবিলম্বে পাহাড়ের আশপাশের এলাকা থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, খুব শিগগিরই সড়কটির সামনে একটি নতুন কংক্রিট সেতু নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি বিকল্প রাস্তা তৈরির কাজও চলছে। এগুলো শেষ হলে ভূমিধসের সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে ২১ লাখ টাকার একটি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ সহায়তা অনেক দেরিতে আসছে।
গ্রামের প্রবীণ মঙ্গলস্বরী দেববর্মা বলেন, এই গ্রাম ছিল ঐতিহ্যের প্রতীক। এখন শুধু ধ্বংসের স্মৃতি রয়ে যাচ্ছে। শুধু ঘর হারাচ্ছে না এখানকার মানুষ, তাদের ইতিহাস-সংস্কৃতিও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অব্যবস্থাপনা ও অবহেলায় তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে মানচিত্র থেকে ত্রিপুরাপল্লির সঙ্গে হারিয়ে যাবে এক জীবন্ত সংস্কৃতির সাক্ষীও।
Leave a Reply