কুলাউড়া প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বন্দুকধারী যুবকের গুলিতে নিহত দিদারুল ইসলামকে (৩৬) স্বজনেরা রতন নামেই ডাকতেন। পরিবারের সব সদস্য যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া পৌর শহরের উত্তর মাগুরা এলাকায় ‘নাঈমা নীড়’ নামে দোতলা বাড়ির চারটি ফ্ল্যাটের একটি বাদে বাকিগুলো ভাড়া দেওয়া।
প্রতিবেশী তাহেরা বেগম (৪৭) সম্পর্কে দিদারুলদের ফুফু। তিনিই বাড়িটি দেখাশোনা করেন। দিদারুলের অকালমৃত্যুতে তাদের পরিবারেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
তাহেরা বলছিলেন, ‘রতনরা (দিদারুল) এক ভাই আর দুই বোন। সবাই নিউইয়র্ক থাকইন। বছরখানেক আগে বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী আর দুই সন্তানরে নিয়া আইয়া বেড়াইয়া গেল। ছুটি বেশি না পাওয়ায় সে (রতন) বেশি দিন থাকতে পারেনি। এক মাসের মতো ছিল। অন্যরা দুই মাস বেড়াইয়া যান। কত হাসিখুশি ছিল ছেলেটা (দিদারুল)। আপন ফুফুর চেয়ে বেশি ভালোবাসত। সকালে নিউইয়র্ক থাকি ফোন পাইলাম, ছেলেটা নাই। শুনিয়া বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ভালা ছেলেটা সবাইরে কান্দাইয়া দুনিয়া থাকি বিদায় নিল।’
মঙ্গলবার দুপুরের দিকে উত্তর মাগুরা এলাকার দিদারুলদের বাসার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, ফাঁকা ঘরটি সোফা, টেবিল, খাট, আলমারিসহ বিভিন্ন ধরনের আসবাবে ভরা। টেবিলে ফ্রেমবন্দী দিদারুল ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কিছু ছবি রাখা।
দিাদরুলদের ফুফাতো ভাই (তাহেরা বেগমের ছেলে) স্নাতকপড়ুয়া আবদুল কাইয়ুম তালাবদ্ধ ফ্ল্যাটের দরজা খুলে সব কক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখান। সব সাজানো-গোছানো। কাইয়ুম জানান, দিদারুলদের মূল বাড়ি পাশের বড়লেখা উপজেলার ছিকামহল গ্রামে। তাঁদের বাবা আবদুর রব একসময় কুয়েতে ছিলেন। ২০০০ সালের দিকে তিনি উত্তর মাগুরায় জমি কিনে বাসা তৈরি করেন। ২০০৯ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সপরিবার যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ওই বছরই (২০০৯) দিদারুল কুলাউড়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এর আগেই বাসার তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রায় ১৫ বছর পর গত বছরের মার্চ মাসের শেষ দিকে দিদারুল দুই বোন বাদে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে প্রথম দেশে বেড়াতে আসেন।
আবদুল কাইয়ুম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর দিদারুল পুনরায় লেখাপড়া শুরু করেন। প্রায় তিন বছর আগে নিউইয়র্কের পুলিশ বিভাগে (এসওয়াইপিডি) কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। সেখানে বসবাসকারী মামাতো বোনকে বিয়ে করেন। তাঁদের আট ও ছয় বছর বয়সী দুই ছেলে আছে। তাঁর স্ত্রী বর্তমানে সন্তানসম্ভবা।
নিউইয়র্কে দিদারুলের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তাহেরা বেগম বলেন, ঘটনার আগের দিন দিদারুল কাজ শেষে ফিরে মাত্র দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেন। জরুরি ফোন পেয়ে ম্যানহাটানে ছুটে যান। ঘটনার কিছু আগে ভিডিও কলে দুই বোনের সঙ্গে কথা বলেন। এটাই ছিল স্বজনদের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা।
দিদারুলদের বাসার নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন কুলাউড়া সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক আবু জাফর সাদেক। দিদারুলকে তিনি পড়িয়েছেন।
আবু জাফর বলেন, ‘আগে পাশের একটি বাসায় ভাড়া থাকতাম। সে হিসেবে অনেক আগে থেকে রতনদের (দিদারুল) প্রতিবেশী। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছি। সে আর্টসের (মানবিক বিভাগ) ছাত্র ছিল। লেখাপড়ায়ও ভালো ছিল। ইংরেজি বা অন্য কোনো বিষয় না বুঝলে আমার কাছে ছুটে যেত। শিক্ষকদের খুবই সম্মান করত। নিউইয়র্কে যাওয়ার আগে তার অনুরোধেই এখানে (দিদারুলদের বাসা) ফ্ল্যাট ভাড়া নিই। নিউইয়র্কে পুলিশে চাকরির খবর শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। সম্ভাবনাময় ছেলেটার এমন মৃত্যু কেউই প্রত্যাশা করিনি। তার মৃত্যুতে সবাই কাঁদছে। সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে পরপারে ভালো রাখেন।’
দিদারুল ইসলামের পরিবার নিউইয়র্কের ব্রংকস এলাকায় থাকে। সোমবার রাতে ম্যানহাটান পার্ক অ্যাভিনিউ এলাকার একটি বহুতল ভবনে তিনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। একপর্যায়ে হঠাৎ শেন ডেভন তামুরা নামের ২৭ বছর বয়সী বন্দুকধারী এক ব্যক্তি সেখানে ঢোকেন। বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিহিত ওই যুবকের সঙ্গে এআর-১৫ রাইফেল ছিল। ভবনে ঢুকেই তিনি এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করেন। এতে দিদারুলসহ চার ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত হন আরও দুজন। পরে বন্দুকধারী যুবক নিজের শরীরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে মারা যান। মঙ্গলবার সকালে দিদারুলের লাশ তাঁর স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ।
Leave a Reply