সর্বশেষ :
সিলেটে সুরমা নদীতে বালুবাহী নৌকা চলাচল নিয়ে বিরোধ, সংঘর্ষে আটক ৪ গোয়াইনঘাটে ফুটবল খেলোয়াড়দের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন জকিগঞ্জে স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণ, ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম স্কুলছাত্র সুমেল মিয়া হত্যা : সিলেটে আটজনের মৃত্যুদণ্ড, ৭ জনের যাবজ্জীবন শহীদ ওয়াসিম ব্রিগেড সিলেট’র বর্ণাঢ্য র‍্যালি সিনেমা থিয়েটারেই পরিচালককে জুতাপেটা করলেন রুচি গুজ্জার! ১৬ বছর ধরে সেতুর নিচে জীবনের নির্মম যুদ্ধ এনসিপির কাছে নীলার প্রশ্ন—এত দিন আমাকে কিসের ভিত্তিতে ব্যবহার করেছেন? ওষুধ কোম্পানির উপঢৌকনে সর্বনাশ হচ্ছে রোগীর পুলিশ অফিসার দিদারুল ছিলেন আমাদের গর্ব: নিউইয়র্কের মেয়র
প্রবাসীর সন্তানদের শৈশব: অপেক্ষার এক দীর্ঘ অধ্যায়

প্রবাসীর সন্তানদের শৈশব: অপেক্ষার এক দীর্ঘ অধ্যায়

সুবর্ণা হামিদ
বাবা মানে হাজার বিকেল আমার ছেলে বেলা,বাবা মানে রোজ সকালে পুতুল পতুল খেলা…। আঙুলে আঙুল ধরে শেখালে তুমি জীবনের পথ চলা, নিজে না খেয়ে তুমি খাওয়ালে শেখালে কথা বলা…।

এমন অসংখ্য গান আর কবিতায় বাবা যেন হয়ে ওঠেন সন্তানের জীবনের প্রথম নায়ক, পথপ্রদর্শক ও ভালোবাসার আশ্রয়। কিন্তু এই আবেগপূর্ণ সংজ্ঞা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের লাখো প্রবাসী শ্রমিকের সন্তানরা।

প্রবাসে থাকা বাবারা জীবিকার তাগিদে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পরিবার থেকে দূরে থাকেন। সেই অনুপস্থিতি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও আবেগিকভাবে সন্তানের শৈশবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা কিংবা নোয়াখালীসহ—বাংলাদেশের বহু জেলায় এমন হাজারো পরিবার রয়েছে, যেখানে সন্তানের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত বাবার স্পর্শ খুব একটা নেই। মা-ই সেখানে বাবা-মা দু’জনের ভূমিকা পালন করেন।

সিলেটের আম্বরখানা বড় বাজার এলাকার প্রবাসীর স্ত্রী সাবিনা আক্তার বলেন – আমার ছেলের বয়স এখন দুই বছরের একটু বেশি। কিন্তু সে এখনো জানে না—বাবার কোলে মাথা রাখা কেমন অনুভূতি, বাবার হাতের স্পর্শ কতটা শান্তির। যখন সে প্রথম হাঁটতে শেখে, তখন তার বাবা ছিলেন কাতারে। আমি ভিডিও কল এ ওর হাঁটা দেখিয়েবললাম ছিলাম, কিন্তু সে আনন্দের মুহূর্তে ওর বাবা পাশে থাকতে পারেনি।

সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে তখন, যখন আমার ছেলে হঠাৎ করেই বলে—আমার আব্বু কই?
সে মাঝে মাঝে ভিডিও কলে বাবাকে দেখে বলেও ফেলে—বাবা, দাঁড়াও! আমি আসতেছি তোমার কাছে।

এই ছোট্ট শিশুর মুখে এমন আবেগভরা কথা শুনে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। চোখে পানি এসে যায়।

দুই বছরের এই শিশুটি জানে না দূরত্ব কাকে বলে সে শুধু অনুভব করে—বাবা পাশে নেই।

সিলেট নগরীর পাঠানটুলা এলাকার একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র তায়েফ। বয়স বারো বছর। কিন্তু তার জীবনে বাবার উপস্থিতি বলতে আছে শুধু একটি স্ক্রিন—ভিডিও কলে দেখা কিছু মুহূর্ত।

তায়েফের বাবা দীর্ঘ এক যুগ ধরে লন্ডনে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। অথচ এই বারো বছরে একবারও বাবা-ছেলের মুখোমুখি দেখা হয়নি। বাবার স্নেহময় হাতের ছোঁয়া, বুকে জড়িয়ে ধরার উষ্ণতা—সবই তায়েফের কাছে এখনো অজানা।

তায়েফের মা হামিদা বেগম বলেন, ওর বাবা ভিডিও কলে কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু তায়েফ তেমন আগ্রহ দেখায় না। এক-দু’টা কথা বলেই চুপ করে যায়। যেন বাবার সঙ্গে হৃদ্যতা তৈরির আগেই এক অদৃশ্য দূরত্ব গড়ে উঠেছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা সিলেটের মানুষ একটা কথা বলি—কায়া দেখলে মায়া বাড়ে।

এই কথার গভীরতা আমি প্রতিদিন অনুভব করি।

ভিডিও কলে কারও মুখ দেখা আর চোখের সামনে প্রিয় মানুষকে পাশে পাওয়া—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আমার তেরো বছরের ছেলেও বুঝে গেছে।

উপলব্ধি আর বাস্তবতা যে এক নয়, সেটা আমি আমার সন্তানের নিঃশব্দ অভিমানেই টের পাই।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাবার অনুপস্থিতি শিশুর আবেগিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। তারা নিরাপত্তা, সান্নিধ্য ও আদর্শের ঘাটতিতে ভোগে। অনেক সময় তা আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ও আচরণগত সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে প্রবাসে থাকা বাবারাও এই দূরত্বে ভোগেন মানসিক যন্ত্রণা।

নগরীর গোয়াইপাড়া এলাকার বাসিন্দা জুয়েল আহমদ কয়েক সপ্তাহ আগে কাতার থেকে দেশে ফিরেছেন। দীর্ঘদিনের প্রবাসজীবন শেষে নিজের পরিবারকে কাছে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরলেও বাস্তবতা তাকে আহত করেছে।

তিনি বলেন,আমি গত মাসে দেশে ফিরেছি, কিন্তু আমার ছোট মেয়ে আমাকে ঠিকমতো চিনতেও পারে না। আমাকে দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে—যেন আমি কোনো অপরিচিত মানুষ। আর আমার ছেলে? ও তো আমার সঙ্গে একসাথে বসে খেতেই চায় না, কথা বলতেও সংকোচ করে।

এই দূরত্বের কারণ আমি জানি—ওদের শৈশবে আমি ছিলাম না। যখন ওরা হাঁটতে শিখেছে, মুখে প্রথম শব্দ উচ্চারণ করেছে, অসুস্থ হয়ে কান্না করেছে—সব সময় পাশে ছিল ওদের মা, আমি নয়। আমি ছিলাম হাজার মাইল দূরের এক অচেনা দেশে, পরিবারের স্বপ্নের জন্য লড়াই করতে করতে সন্তানদের শৈশবটা মিস করে ফেলেছি।

জুয়েলের কণ্ঠে আক্ষেপের সঙ্গে মিশে ছিল গভীর এক অনুতাপ, যেটা অনেক প্রবাসীরই নিরব বেদনা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সামাজিক ব্যত্যয় মোকাবিলায় দরকার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ—যেমন পরিবারভিত্তিক কাউন্সেলিং, ভিডিও কলের মতো প্রযুক্তির আরও কার্যকর ব্যবহার, কিংবা ছুটিতে ফিরে বাবাদের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য বিশেষ কর্মসূচি।

এ বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থাপক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টিআইপি হিরো অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত আল-আমিন নয়ন বলেন— প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা এমন সব বাস্তব চিত্রের মুখোমুখি হই, যা হৃদয় ভার করে দেয়। তারা কেবল অর্থহীন হয়ে দেশে ফেরেন না—ফিরে আসেন ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন, হারিয়ে যাওয়া সময়, আর অদৃশ্য গভীর ক্ষত নিয়ে।

যে সময়টুকু একজন সন্তানের পাওনা ছিল তার বাবার কাছ থেকে—সেই সময়টিই তারা বিসর্জন দেন প্রবাসের কঠিন জীবনে।

তিনি বলেন – প্রবাসে রোজগার হয়তো বাড়ে, কিন্তু সন্তানের হৃদয়ে বাবার শূন্যতা দিন দিন গভীর হয়। টাকার অভাব মিটে গেলেও, বাবার কাঁধে মাথা রাখার সেই ছোট্ট স্বপ্নটা অপূর্ণই থেকে যায়।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন—মায়ের কোল সন্তানের জন্য যতই নিরাপদ হোক না কেন, বাবার হাত না থাকলে তার জীবন থেকে একটা বড় ছায়া হারিয়ে যায়। বাবা সন্তানের জন্য কেবল উপার্জনকারী নন—তিনি হন আদর্শ, অনুপ্রেরণা, আর সাহসের উৎস।

যেখানে বাবা অনুপস্থিত, সেখানে সন্তান শিখে নেয় এক ধরনের নিঃশব্দ অভিভাবকহীনতা। তার ভেতরে জন্ম নেয় এক নিঃসঙ্গতা, যে শূন্যতা অনেক সময় আর কোনো ভালোবাসা পূরণ করতে পারে না।

তাই প্রবাসে থাকা বাবাদের অনুরোধ করবো—আপনার সন্তান কেবল টাকার প্রয়োজন দেখে না, সে চায় আপনার সময়, ভালোবাসা, আর পাশে থাকার অনুভব। কাজের জন্য দূরে থাকতেই পারেন, তবে তাদের হৃদয় থেকে যেন আপনি দূরে না সরে যান। সন্তান যেন কখনো অনুভব না করে—তার বাবা আছে, কিন্তু পাশে নেই।

নগরীর খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাসেদ নেওয়াজ বলেন—প্রবাসী বাবার সন্তানেরা অনেক সময় বন্ধুদের সামনে নিজের আবেগ গোপন রাখে,অনেক সময় হাসিখুশি মনে হলেও, তাদের ভেতরে এক ধরনের একাকীত্ব কাজ করে। তারা বন্ধুদের সামনে কিছু বোঝায় না, কিন্তু বাবার অভাবটা মনে খুব গভীরভাবে লাগে। অনেক অনুষ্ঠানে তারা চুপচাপ থাকে, কারণ তাদের পাশে বাবা থাকে না। এই শূন্যতা অনেক সময় তাদের মন ও আচরণে প্রভাব ফেলে।

প্রবাসী আয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে কম নয় প্রবাসীর সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্য ও শৈশবের সুরক্ষা।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.




© All rights reserved ©ekusheysylhet.com
Design BY DHAKA-HOST-BD
weeefff