শিক্ষকদের সম্মান ও শিক্ষার মানোন্নয়নে সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন

শিক্ষকদের সম্মান ও শিক্ষার মানোন্নয়নে সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন

সাখাওয়াত হোসেন

বর্তমান সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফলাফল বা শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ব্যর্থতার জন্য প্রায়শই একজন বা একাধিক শিক্ষককে দায়ী করে সামাজিক মাধ্যমে কিংবা অভ্যন্তরীণ পরিবেশে সরব আলোচনা লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় শিক্ষককে ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য করে নাম উল্লেখ করে দোষারোপ করা হয়, যা একজন শিক্ষক ও মানুষ হিসেবে তাঁর পেশাগত মর্যাদা, মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সরাসরি আঘাত হানে। অথচ একজন শিক্ষক প্রতিদিন কতটা নিষ্ঠা, ধৈর্য ও শ্রম দিয়ে শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের জন্য কাজ করেন—তা কেবল আরেকজন শিক্ষকই উপলব্ধি করতে পারেন।

একটি ফলাফলের জন্য দায়ী অনেকগুলো উপাদান থাকে—শিক্ষার্থীর মনোভাব, নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিতি, পারিবারিক সহযোগিতা, বিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ, সহপাঠী ও শিক্ষকের সম্পর্ক, শিক্ষকের পাঠদানের মান, এবং মনিটরিং ব্যবস্থা। এর মাঝে একটিকে আলাদা করে দোষারোপ করলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।

সিলেটের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেমন—সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, এবং বিজিবি পাবলিক স্কুল ও কলেজ—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাফল্যের অন্যতম কারণ হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও প্রশাসনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা ও যৌথ প্রচেষ্টা।

এসব প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষে পাঠদানই নয়, শিক্ষার্থীদের উন্নতির জন্য বিশেষ ক্লাস, সাপ্লিমেন্টারি লেসন, মেন্টরিং সেশন, এবং মক পরীক্ষা আয়োজন করা হয়। যেসব শিক্ষার্থী দুর্বল, তাদের জন্য আলাদাভাবে সহায়তা প্রদান করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত চর্চার সুযোগ পায়, তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে, এবং ফলাফল ইতিবাচক হয়।

অপরদিকে, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা যায়, ছাত্র ফেল করলেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে দোষারোপ করা হয়। তাঁর নাম নিয়ে গুঞ্জন ছড়ানো হয়, কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে হেয় করার প্রয়াস চালানো হয়। এই প্রক্রিয়াটি যেমন অশোভন, তেমনি শিক্ষকতার মহান পেশার প্রতি চরম অসম্মানজনক।

আমরা যদি বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করি, দেখা যাবে—বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থী ভালো করছে, তাদের অনেকেই বাসায় প্রায় প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা শিক্ষক রাখছে। পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী তারা সন্তানদের জন্য কোচিং, প্রাইভেট বা এক্সট্রা কেয়ারের ব্যবস্থা করছে। এতে তাদের শিক্ষাগত প্রস্তুতি সুদৃঢ় হচ্ছে।

তাছাড়া, সিলেটের যেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ভালো ফল করছে, তাদের অনেকেই শহরের বিভিন্ন নামকরা কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে আলাদাভাবে পড়াশোনা করছে। সিলেট শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব কোচিং সেন্টার তাদের পরীক্ষাভিত্তিক প্রস্তুতিকে আরও মজবুত করছে। ফলে তারা গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে এ বিষয়গুলো পর্যালোচনার সময় শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গ, অপমান বা দোষ চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি একটি শিক্ষিত সমাজে কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং শিক্ষকের মানবিক ও পেশাগত মর্যাদাকে সম্মান জানিয়ে বিষয়গুলোর গঠনমূলক সমাধান করা উচিত।

বলা প্রয়োজন, অনেক সময় অভিভাবকরাই শিক্ষকদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন—“স্যার, বাচ্চাটা দুর্বল, একটু আলাদাভাবে দেখলে ভালো হয়।” শিক্ষকও তাঁর পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে সেই সন্তানকে আলাদাভাবে সময় দেন, সহানুভূতির সাথে পড়ান। এটি একটি মানবিক আচরণ, কোনো অপরাধ নয়।

তবে এর মানে এই নয় যে সব শিক্ষকই নির্দোষ বা ত্রুটিমুক্ত। কিছু শিক্ষক দেরিতে বিদ্যালয়ে আসেন, ক্লাসের সময় অপচয় করেন, দায়িত্বে অবহেলা করেন—এসবই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন অভ্যন্তরীণ নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি নিয়মিত মূল্যায়ন, পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং চালু রাখে, তাহলে এসব অনিয়মও কমে আসবে। কিন্তু সেটি হতে হবে সম্মানজনক ও পেশাগত পরিবেশ বজায় রেখে।

স্মরণ রাখতে হবে, শিক্ষকের মনোবল যদি ভেঙে যায়, তাঁর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায়—তাহলে শ্রেণিকক্ষে তাঁর পারফরম্যান্স প্রভাবিত হবে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যেও তার নেতিবাচক প্রতিফলন দেখা দেবে। তাই সমালোচনার ভাষা হতে হবে গঠনমূলক, এবং তা হতে হবে শ্রদ্ধাশীল।

সিলেটের অভিজাত ও সফল বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, অভিভাবক ও পরিচালনা পরিষদের মধ্যে সম্মিলিত সমন্বয় এবং পেশাদারিত্বের পরিবেশ বিদ্যমান বলেই তারা ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। সেখানে কোনো শিক্ষার্থী ব্যর্থ হলে এককভাবে শিক্ষককে নয়, গোটা ব্যবস্থাকে পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

আমাদের উচিত সেই মডেল অনুসরণ করা—পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কাজ করা। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, দায়িত্ব বণ্টন, সময়ানুবর্তিতা এবং পাঠদানের মান উন্নয়নের জন্য নিয়মিত রিভিউ সেশন, অভ্যন্তরীণ কর্মশালা এবং অভিভাবক-শিক্ষক সভা হওয়া উচিত। এতে করে একদিকে যেমন শিক্ষকের দায়বদ্ধতা বাড়বে, অন্যদিকে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীও দায়িত্বশীল হবে।

পরিশেষে বলা যায়, একজন শিক্ষককে সম্মান জানানো মানে একটি জাতিকে সম্মান জানানো। শিক্ষা শুধু পরীক্ষার ফল নয়—এটি একটি মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রক্রিয়া। তাই শিক্ষককে ছোট করে নয়, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে, সম্মান জানিয়ে, গঠনমূলক সহায়তার মধ্য দিয়ে আমরা যদি এগিয়ে যাই—তবেই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হবে।

চলুন, আমরা কেউ কাউকে দোষারোপ না করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আলোকিত করতে হলে, শিক্ষকদের সম্মান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.




© All rights reserved ©ekusheysylhet.com
Design BY DHAKA-HOST-BD
weeefff