একুশে সিলেট ডেস্ক
ওসমানীতে এত জঞ্জাল। পরতে পরতে দুর্নীতির ছাপ। এ নিয়ে কর্মকর্তারাও থাকেন রহস্যময় ভূমিকায়। মন্ত্রী, এমপিরা প্রায় সময় হস্তক্ষেপ করতে চান। লম্বা দাবি নিয়ে হাজির হন সংশ্লিষ্টরা। বোঝাতে চান, সংকটেও সেবা চলছে। তাদের এই যুক্তির কাছে সবাই চুপ হয়ে যান। তবে, ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। চিকিৎসাসেবা থেকে সবখানেই আছে অভিযোগের পাহাড়। কর্মকর্তা, কর্মচারীরা স্বেচ্ছাচারিতা চালান।
আগস্ট মাসের শেষ দিকে সিলেটে যোগদান করেন বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম। তিনি আসার সঙ্গে সঙ্গে একাধিক তরফ থেকে নানা বিষয়ে অভিযোগ আসে তার কাছে। এর মধ্যে যে দাবিটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, সেটি হচ্ছে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চিকিৎসাসেবা, অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। জেলা প্রশাসক এসেই সিলেটের সাদাপাথর কাণ্ডে নজর দেন। তার কয়েক দিনের মিশনে পাথর রাজ্য পিনপতন নীরব হয়ে পড়ে। বালুখেকোরা পিছু হটেছে। খুব কম সময়েই জেলা প্রশাসক সেটি করতে পেরেছেন।
এরপর তিনি নজর দেন ওসমানী হাসপাতালের দিকে। নিজে ঘুরে দেখেন হাসপাতাল। জনগণ থেকে উত্থাপিত অভিযোগ অমূলক নয়। সেটি তিনি প্রথমেই বুঝতে পারেন। হাসপাতালের প্রধান গেইট থেকে শুরু অনিয়মের চিত্র। আছে দুর্নীতির গন্ধও। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনি কয়েক দফা সফর করে ওসমানী হাসপাতাল। সংকট, অনিয়ম খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। যে খোঁজ অতীতে কেউ করেননি। হাসপাতালের সবখানেই সিন্ডিকেট। ওষুধ মিলে না হাসপাতালে।
এ অভিযোগে ওষুধ স্টোরও ঘুরে দেখেন। মেঝেতে থাকা রোগী, দালালদের দৌরাত্ম্য, কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা, ডাক্তারদের অবহেলা, বাইরের হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আধিপত্য সবই তার চোখে ধরা পড়েছে। যে ক’দিন তিনি হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন প্রতিদিনই দিয়েছেন নতুন নতুন বার্তা। হাসপাতালটি ৫০০ শয্যার। সুবিধা ৯০০ শয্যার। প্রতিদিন সেবা দেয়া হচ্ছে দুই থেকে তিন হাজার রোগীর। এটি কেবল ওসমানীর বেলায় প্রযোজ্য নয়। সব বিভাগ ও জেলাতেও একই অবস্থান। তবুও চলছে চিকিৎসাসেবা। কিন্তু ওসমানীতেই অভিযোগের পাহাড়ই কেবল ব্যতিক্রম।
সিলেট বিভাগের জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। জরুরি প্রয়োজনে রোগীদের আসতে হয় এই হাসপাতালে। কিন্তু সেবার মান নিয়ে এত প্রশ্ন। ডাক্তারদের নিয়েও অভিযোগের অন্তু নেই। সময়মতো ডাক্তার মিলে না। অপারেশনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। নার্সরা সিন্ডিকেট গড়েছে। গোয়েন্দা তদন্তে মিলেছে অর্ধশতাধিক নার্স ছুটি না নিয়েই বাইরে চলে গেছেন। কয়েক বছর আগে চাকরি দেয়ার নামে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দুই ব্রাদার। এ নিয়ে মামলা হয়েছে। দুদক অনেক কিছুই মাথায় নিয়ে হাসপাতালের তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে সিলেট দুদকের কর্মকর্তারাও হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন। কাগজপত্র নিয়েছেন। এখন চলছে যাচাই-বাছাই। খাবারের মান নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। রোগীরা চার্টমতো খাবার পান না।
অব্যবস্থাপনা প্রচুর। প্যাথলজিক্যাল সেক্টরেও আছে অভিযোগ। সব সময় সেবা মিলে না। মেশিন নষ্ট থাকে বছর জুড়ে। এ কারণে হাসপাতালের বাইরে লাইন থাকে রোগীদের। ওসমানীর দালাল সিন্ডিকেট রোগী ও স্বজনদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের। শতাধিক দালাল। তারা বাইরের ফার্মেসির নিয়োজিত। আছে চোরদের উৎপাতও। রোগী ও স্বজনের টাকা পয়সা ও মালামাল চুরির অভিযোগ প্রায়ই পুলিশের কাছে আসে। এভাবে হাসপাতাল চলছে কীভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে বৃহস্পতিবার পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের কাছে জেলা প্রশাসক জানান, রোগী আড়াই থেকে তিন হাজার। তাদের স্বজন ৫ থেকে ৬ হাজার। এত মানুষ হাসপাতালে থাকলে ব্যবস্থাপনা থাকার কথা না। এজন্য রোগীর স্বজন কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া, নির্ধারিত সময়ের বাইরে কেউ যাতে রোগীদের সঙ্গে দেখা করতে না যান সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এদিকে, আপাতত ওসমানী হাসপাতালের ওপর চাপ কমানোর ওপর নজর দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
শামসুদ্দিন হাসপাতালের পাশে একটি জেলা হাসপাতাল প্রস্তুত। কার্যক্রম শুরু করতে হলে সরঞ্জাম, ডাক্তার, নার্স সবই লাগবে। এটি একটি বড় কাজ। এ হাসপাতাল নিয়ে গণপূর্তের সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগের রশি টানাটানি চলছিল। হাসপাতাল সমঝে নিতে রাজি ছিল না স্বাস্থ্য বিভাগ। পরে অবশ্য নিয়েছে। ইতিমধ্যে কমিটি করে দেয়া হয়েছে। এই কমিটি কাজ করছে। জেলা প্রশাসক বলেন, নতুন হাসপাতাল চালু হলে ওসমানীর ওপর চাপ কমবে। এটি চালু হতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগতে পারে। অন্যদিকে, জেলা হাসপাতালের পাশেই শামসুদ্দিন হাসপাতাল। সেটিতেও নানা অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এই হাসপাতালও কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না। সংকট সব সময়ই লেগে থাকে। এটিকে শিশুদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল করার জন্য বিগত সরকারের প্রস্তাবনা ছিল। ওই প্রস্তাবনা এখন ধামাচাপায় পড়েছে।
ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি নতুন করে পরিধি বাড়ানোর কাজ চলছে। রেডিওলজি, ক্যান্সার হাসপাতালের ভবন হচ্ছে। সেই কাজেও গতি নেই। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে কাজ চলছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে গণপূর্তের সচিব নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ওই হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক।
শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সিলেট খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করা হবে। এই হাসপাতাল চালু হলে সিলেটসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের আর ঢাকায় বা দেশের বাইরে যেতে হবে না। আগামী তিন মাসের মধ্যে সিলেটের ক্যান্সার হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হবে।
জেলা প্রশাসক সারওয়ার আলম বলেন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছেন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিদর্শন করা। ক্যান্সার হাসপাতালের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। তারা দেখতে এসেছেন কাজ কতোদূর অগ্রসর হয়েছে এবং সম্পূর্ণ হতে আর কতো সময় লাগবে। আমরা আশা করছি, আগামী তিন মাসের মধ্যেই ক্যান্সার হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।
Leave a Reply