সর্বশেষ :
গোয়াইনঘাটে এক মামলায় ৩ কোটি টাকার বিছনাকান্দির পাথর ‘হজম’ জাফলংয়ে টাস্কফোর্সের অভিযান, ৩ জনের কারাদণ্ড পাথর লুটে নাম: ‘হলুদ মিডিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর’ আহ্বান যুবদল নেতা মকসুদের দোয়ারাবাজার সীমান্তে ভারতীয় মোটরসাইকেল আটক আর একটি পাথরও যদি সরানো হয়, জীবন ঝালাপালা করে দেব:  ডিসি ‘পুরুষ ভালোবাসি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঘৃণা করি’ পাথর লুট নিয়ে দুদকের প্রতিবেদন : জামায়াত বলছে ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’, এনসিপি বলছে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ নবীগঞ্জে সিএনজি গ্যাস পাম্পে ফিটনেসবিহীন বাস থেকে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের সুত্রপাত ‘বিশ্বের সবচেয়ে দয়ালু বিচারক’ ফ্র্যাঙ্ক ক্যাপ্রিও আর নেই অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের তৃতীয় হার
সাদাপাথর লুটে জড়িত ৪২ জনের নাম প্রকাশ

সাদাপাথর লুটে জড়িত ৪২ জনের নাম প্রকাশ

একুশে সিলেট ডেস্ক
সিলেটের পাথরকাণ্ডে একের পর এক বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। এই লুটপাটে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি সঙ্গ দিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসনের প্রায় সর্বস্তরের কর্মকর্তারা। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), সহকারী কমিশনার (ভূমি), পুলিশ সুপার (এসপি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং কোম্পানীগঞ্জে দায়িত্বপ্রাপ্ত চারজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সরাসরি মদদ ছিল পাথর লুটপাটে।

এ ছাড়া টাকার ভাগ পেয়েছেন জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও পুলিশের বিশেষ ইউনিট পুলিশ ইন্টার্নাল ওভারসাইটের (পিআইও) দুজন কর্মকর্তা। পুলিশকে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা দেওয়া হতো ৩টি শর্তে। স্থানীয় বিজিবির সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে। সব মিলিয়ে ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুটপাটে প্রায় ৮০ কোটি টাকা কমিশন ঢুকেছে স্থানীয় প্রশাসনের পকেটেই।

কালবেলার নিজস্ব অনুসন্ধান, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) রাষ্ট্রীয় বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে, সিলেটে পাথর লুটে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩১ নেতাকর্মীসহ ৪২ জন সরাসরি জড়িত রয়েছেন।

স্থানীয় পরিবেশবাদীদের মতে, সিলেট থেকে অন্তত ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে। প্রতি ট্রাকে ৫০০ ঘনফুট করে হলে ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুটতে প্রয়োজন হয়েছে অন্তত ৮০ হাজার ট্রাক। দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, প্রতি ট্রাকে ১০ হাজার টাকা করে কমিশন পেলে ডিসি-এসপিসহ স্থানীয় প্রশাসনের পকেটে ঢুকেছে অন্তত ৮০ কোটি টাকা।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের পাথর উত্তোলন করে তা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নদী ও পর্যটন এলাকা থেকে পাথর চুরি করে প্রথমে স্থানীয় স্টোন ক্রাশার কারখানাগুলোয় জমা করা হয়। পরে এসব পাথর ভেঙে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। যাতে চুরি করা পাথরের অস্তিত্ব না পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, লুট করা পাথর প্রতি ট্রাকে ৫০০ ঘনফুট করে সরিয়ে নেওয়া হতো। প্রতি ঘনফুট ১৮২ টাকা করে হিসাব করা হতো। সে হিসাবে ট্রাকপ্রতি পাথরের দাম পড়ে ৯১ হাজার টাকা। এখান থেকে ট্রাকপ্রতি ১০ হাজার টাকা যেত জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা এসপি, সংশ্লিষ্ট থানার ওসি, থানা পুলিশ ও ডিবির পকেটে। এ ছাড়া নৌকাপ্রতি উত্তোলন করা হতো ১ হাজার টাকা। জেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশের মধ্যে ৫ হাজার টাকা করে ভাগ হতো। এ ছাড়া নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা করে পেতেন তারা। আরও ভাগ পেতেন ইউএনও, এসিল্যান্ড ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তহশিলদার। পুলিশের অংশের ভাগ পেতেন এসপি, সার্কেল এসপি, ওসি এবং কোম্পানীগঞ্জ থানার অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা ও জেলা ডিবি কর্মকর্তারা। টাকা যেত বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পিআইওতে। এ সংস্থাটিকে বলা হয় ‘পুলিশের চোখ ও কান’। সংস্থাটির কাজ হলো—পুলিশ সদস্যদের কার্যক্রম নজরদারি, দুর্নীতি ও অদক্ষতার তথ্য সংগ্রহ ও তদন্ত। এর মাধ্যমে, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করা হয় এবং পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিমুক্তকরণে সহায়তা করা হয়। তবে নিজেদের ভাগ ছাড়েননি এ সংস্থারও দুই সদস্য। তারা হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) রানাকান্ত ও কনস্টেবল দেলোয়ার।

রাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সংস্থা পাথর লুটপাটে জড়িতদের চিহ্নিত করেছে। এ রকম একাধিক প্রতিবেদন এসেছে কালবেলার হাতে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাদাপাথর মূলত খনিজ সম্পদ। খনিজ সম্পদ সম্পর্কিত সব দায়দায়িত্ব খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) ওপর ন্যস্ত। তবে পাথর লুটপাটের ঘটনায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। সে হিসেবে সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা পাথর লুটের অপরাধে দায়ী। এ ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী পাথর উত্তোলন বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার পরিবর্তে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থ রক্ষার অভিযোগ আনা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

তদন্তে সিলেটের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। তার বিরুদ্ধে সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার প্রমাণ পেয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এ ছাড়া তার অধীন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে না পারাও লুটপাটের অন্যতম কারণ।

পাথর লুটপাটে সরাসরি চারজন ইউএনওর দায় মিলেছে অনুসন্ধানে। তাদের মধ্যে আছেন কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার, যিনি দায়িত্ব পালন করেছেন চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত। আরও আছেন গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা ইউএনও মোহাম্মদ আবুল হাসনাত; গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা ঊমী রায় এবং গত বছরের ১১ জুলাই থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা আবিদা সুলতানা।

একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ইউএনও তাদের দায়িত্ব পালনকালে নামমাত্র ও লোক দেখানো কিছু ব্যবস্থা ছাড়া পাথর লুট বন্ধে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নেননি।

পুলিশ সুপারের দায়দায়িত্বে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন এবং পরিবহন বন্ধে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিলেও সিলেটের এসপি মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সাদাপাথর উত্তোলন বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। এসপির নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশের কারণে দুষ্কৃতকারীদের পক্ষে সাদাপাথর লুটপাট করা সম্ভব হয়েছে।

ওসির দায়দায়িত্বে বলা হয়েছে, কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে উজায়ের আল মাহমুদ আদনানসহ সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ অবৈধ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে পাথর লুটপাটে সহায়তা করেছেন। থানা পুলিশের নির্দিষ্ট সোর্স কখনো নিজেরাই এ চাঁদার টাকা উত্তোলন করতেন। অর্থ উত্তোলন ও সার্বক্ষণিক তদারকির দায়িত্ব পালন করেছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ছয়টি বিটের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া এ লুটপাটে কোম্পানীগঞ্জ থানা ও গোয়াইনঘাট থানার প্রায় সব পুলিশ কর্মকর্তা কমিশন পেয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনকে টাকা দেওয়া হতো তিনটি শর্তে। সেগুলো হলো—পাথরের ট্রাক না আটকানো, অভিযান না চালানো এবং অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে বাধা প্রদান না করা।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সাদাপাথর উত্তোলনে বিজিবি সদস্যদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিজিবি সদস্যরা নৌকাপ্রতি ৫০০ টাকা করে উত্তোলন করতেন। একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে জড়িতরা হলেন কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, মনির মিয়া, হাবিল মিয়া ও সাইদুর রহমান।

জানতে চাইলে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘পাথর লুটকাণ্ডে সিলেটের একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রধান কার্যালয়ে এসেছে। আগামী সপ্তাহে এটি কমিশনে তোলা হবে এবং অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পাথর লুটে যারাই জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.




© All rights reserved ©ekusheysylhet.com
Design BY DHAKA-HOST-BD
weeefff