আহমদ রেজা চৌধুরী
একটি শহর—যেখানে মাঝ দুপুরে উঠেছিল বিজয়ের হুংকার, আর সন্ধ্যার আগেই নেমে আসে শোকের গভীর ছায়া।
একটি দিন—যে দিনটা ইতিহাসে লেখা হয়েছে রক্তে, চোখের জলে আর না বলা প্রশ্নে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট।
ঢাকার রাজপথে যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেখ হাসিনার পদত্যাগে পৌঁছায় চূড়ান্ত রূপে, তখন বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে, প্রতিটি মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল একটাই শব্দ— ‘বিজয়’। আর সেই একই দিনেই, সিলেটের সীমান্তঘেঁষা শান্ত শহর বিয়ানীবাজারে এঁকে গেল এক লাল রেখা। একটি শহরের গর্ব, অশ্রু আর প্রশ্ন একাকার হয়ে গেল ৩৬ জুলাইয়ের নামকরণে।
রায়হান, ময়নুল, আর তারেক—তিন তরুণ, তিন স্বপ্ন, তিনটি নাম আজ বিয়ানীবাজারের রাজপথে লেখা আছে অমোচনীয় রক্তরেখায়। সেদিন দুপুরের উত্তাল মিছিলে তাদের ছিল জয়ধ্বনি। কিন্তু বিকেলে সেই মিছিলই বুকে গুলি নিয়ে থেমে যায়। পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ছোড়া গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রায়হান ও ময়নুল। গভীর রাতে থানার অভ্যন্তর থেকে উদ্ধার হয় তারেকের নিথর দেহ।
তারেক আহমদের স্ত্রী ছামিয়া আক্তার বলেন, “আমি চাই, আমার ছেলে জানুক—তার বাবা কেবল একজন মানুষ ছিলেন না, একজন শহীদ ছিলেন।”
বিয়ানীবাজারে ৫ আগস্ট দুপুর ছিল রঙিন। ঢাকায় ‘স্বৈরাচার পতনের’ খবরে শহরে আনন্দ মিছিল, মানুষের ঢল, জাতীয় পতাকার ছায়া পড়েছিল শিশুদের মুখেও। সেই আনন্দ মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় থানার সামনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে। মুহূর্তেই গুলির শব্দ, আতঙ্ক, কান্না। যারা কিছুক্ষণ আগেও জয়ধ্বনি দিচ্ছিল, তারা তখন লাশ বয়ে নিচ্ছে।
রায়হান আহমদের ছোট ভাই সিয়াম আহমদের কণ্ঠ কাঁপে, চোখে কেবল ক্ষোভ নয়, অভিমানও ভর করে।
সে বলে, “এক বছর হয়ে গেল। ভাইয়ের লাশ কাঁধে নিয়েছি, কবর দিয়েছি। কিন্তু বিচার এখনো কেবল ফাইলে ঘুমাচ্ছে।”
শুধু তিনজন নয়। ১৮ জুলাই সিলেটে শহীদ হন সাংবাদিক আবু তাহের মোহাম্মদ তুরাব।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান এই সৎ ও সাহসী সাংবাদিক। তাঁর বড় ভাই আবু আজরফ মো. জাবুর আজও বিচারের দাবিতে বদ্ধপরিকর।
আর নারায়ণগঞ্জে মারা যান বিয়ানীবাজারের কাকুরা গ্রামের সোহেল আহমদ—ঢাকার মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে।
বিয়ানীবাজার থানায় দায়ের হয় চারটি মামলা—তিনটি হত্যা ও একটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে। আসামির তালিকায় সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, এমনকি স্থানীয় সাংবাদিকরাও।
তবু শহীদ পরিবারগুলোর প্রশ্ন—“চার্জশিট কই? শাস্তি কই?”
এ বিষয়ে থানার ওসি মো. আশরাফ উজ্জামান বলেন, “তদন্ত চলছে। যারা জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
তবে এই একই কথা পরিবারগুলো গত এক বছর ধরে শুনছে—ফারাক শুধু, কবরস্থানে আরও এক বছর পেরোল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মুস্তাফা মুন্না বলেন, “জুলাইয়ের শহীদরা আমাদের প্রেরণা। প্রশাসন তাঁদের পাশে আছে।”
কিন্তু বাস্তবে শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো মানে কেবল ফুল দেওয়া নয়, তাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়া, তাদের যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়া।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বর যেমন etched in memory, বিয়ানীবাজারের জন্য তেমনি ৩৬ জুলাই এক প্রতীকী দিন—বিজয় আর বেদনার দ্বৈত মুখ।
এই তরুণদের রক্তের ঋণ, এই মাতা, স্ত্রী কিংবা সন্তানের কান্নার দাম—দিতেই হবে।
লেখক : আহমদ রেজা চৌধুরী
তরুণ কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
Leave a Reply