কাওছার আহমেদ রাসেল:
আজ ৫ই আগস্ট ।২০২৪ এর ৫ ই আগষ্ট বাঙ্গালী জাতির জন্য শুধু ঘটনাবহুল একটি দিন নয়-এটি ছিল এক অভূতপূর্ব গণপ্রতিরোধ। সারা দেশে বিগত ১৬ বছরের ছাত্র-জনতার পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, ক্রোধ, বেদনা ও নৈতিক জাগরণ একত্রিত হয়ে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হয়েছিল।সেদিন দেশ ব্যাপী একদফা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ ঢেউ আছড়ে পড়েছিল গোটা বানিয়াচংয়ে।৫ই আগষ্ট হাসিনা পতনের একদফা আন্দোলনে বানিয়াচংয়ে শহীদ হয়েছেন নয়জন।গন অভ্যুত্থান আন্দোলনে সিলেট বিভাগে একমাত্র বানিয়াচংয়ে ওই দিন শত শত মানুষ বুলেটবিদ্ধ হয়েছেন।যা বানিয়াচংবাসীর কাছে পরিণত হয়েছিল এক বিভীষিকাময় দিনে।
২০২৪ এর জুলাই কোটা আন্দোলনে উত্তাল গোটা দেশ।১৯ শে জুলাই বড় বাজার শহীদ মিনারের সামনে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের সাথে সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ।এই ঘটনায় বানিয়াচংয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে।আন্দোলন দমাতে ব্যাপক ধর-পাকড় চালায় পুলিশ।২২ জুলাই আন্দোলনকারীদের নামে দেয়া হয় পুলিশ এসল্ট মিথ্যা মামলা।বিএনপির ৯০ জন নেতা-কর্মীকে এজাহার ভুক্ত করে অজ্ঞাত আসামী করা হয় ৭০০ জন।আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠে পুরো বানিয়াচং।এই মামলাকে পুঁজি করে পুলিশের সাথে মিলে বানিজ্যে নামে ছাত্রলীগ,যুবলীগ।বাবাকে না পেয়ে ছেলেকে।বড় ভাইকে না পেয়ে ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে আসতে থাকে তৎকালীন থানা পুলিশ।এতে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়ে দানা বাঁধতে থাকে মানুষের মনে।
৪ঠা আগষ্ট প্রতিবাদ মিছিলের জন্য স্থানীয় এল আর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হতে থাকেন ছাত্র-জনতা।এদিকে বড় বাজার শহীদ মিনারে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ,যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী।ছাত্রলীগ যুবলীগের অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে কেঁপে উঠে বানিয়াচং এর হাটবাজার।দুপুর বারো টার দিকে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে গুনিনগঞ্জ বাজার হয়ে বড় বাজারের দিকে অগ্রসর হলে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে আসতে থাকে একের পর এক হুমকি।জনাব আলী কলেজের সামনে মিছিলকারীদের পুলিশ লাঠিচার্জ,টিয়ার গ্যাস ও ছররা গুলি ব্যবহার করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।৪ঠা আগষ্ট রাতে স্থানীয় বিএনপি নেতৃবৃন্দ পাড়ায় পাড়ায় ঘরোয়া মিটিং করে সবাইকে ঐক্যবদ্দ হওয়ার আহবান জানান।সিদ্ধান্ত হয় ৫ আগষ্ট কারফিউ ভেঙ্গে মিছিল করার।বানিয়াচং হয়ে উঠে আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ।
৫ আগষ্ট কারফিউ ভেঙ্গে সকাল থেকেই ঘর থেকে বেরিয়ে দলে দলে এল আর সরকারী উচ্ছ বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো হতে থাকেন ছাত্র-জনতা।সকাল ১০ টার মধ্যেই সাগর দিঘীর পাড়ে জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ।১১ টায় বড় বাজার শহীদ মিনার অভিমুখে যাত্রা করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গনমিছিল।বড় বাজার চৌরাস্তার মোড়ে পথ সভার মাধ্যমে মিছিলের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়।লাখো জনতার মিছিলের একাংশ উপজেলা হয়ে যাত্রা করে থানা অভিমুখে।মিছিল উপজেলার সামনে যাওয়া মাত্রই মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা।এ খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।হাজার হাজার জনতার মিছিল ছুঁটে থানা ঘেরাও করতে।স্থানীয় শাহী ঈদগাহের সামনে পৌছামাত্র ই মিছিলকারীদের উপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে স্বশস্ত্র ছাত্রলীগ,যুবলীগের ক্যাডার ও পুলিশ বাহিনী।ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুললে পিছু হটে ছাত্রলীগ,যুবলীগ ও পুলিশ বাহিনী অবস্থান নেয় থানার সামনে।চারদিক থেকে এলোপাতাড়ি গুলিতে ঘটনাস্থল থানার সামনে নিহত হন মো:হাসাইন সহ সাতজন।বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় আনাছ ও আকিনুর সিলেট ওসমানী হাসপাতালে মৃত্যু বরন করেন।গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন শতাধিক।তাৎক্ষনিক হাজার হাজার বিক্ষুদ্ধ জনতা ঘেরাও করে রাখে বানিয়াচং থানা।খবর পেয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী থানার সামনে অবস্থান নেয়।ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কয়েক হাজার ক্ষুদ্ধ জনতাকে শান্ত করে বারো ঘন্টা পর রাত ২টায় অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে সেনাবাহিনী।ঐ রাতে ই বিক্ষুদ্ধ জনতার গনপিটুনিতে এস আই সন্তোস চৌধুরী নিহত হন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়,নয়জন শহীদের ঘটনায় সাবেক এমপি ময়েজ উদ্দিন শরীফ উদ্দিন রুয়েল কে প্রধান আসামী করে ১৫৯ জনের বিরুদ্বে মামলা দায়ের করেন শহীদ হাসাইনের পিতা মো:ছানু মিয়া।এ মামলা কে জড়িয়ে বিস্তর বানিজ্যের অভিযোগ উঠে রাজনৈতিক নেতা সহ পুলিশের বিরুদ্ধে।নাইন মার্ডার মামলায় এ পর্য়ন্ত ২৫ জনকে আটক করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয়েছেন এখন পর্যন্ত পাঁচ জন।মামলার এক বছর পেরিয়ে গেলে ও চার্জশীট দিতে পারেনি পুলিশ।
সূত্রে জানা গেছে,মামলা কে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ফ্যাসিষ্ট আ,লীগ মাঠে নামায় তাদের কিছু পেইড এজেন্ট।তদন্ত কাজে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে সাংবাদিক পরিচয়ে আ,লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক সহ বিভিন্ন মিডিয়ায় চালানো হয় অপ-প্রচার।মব তৈরী করে আইন শৃঙ্খলা অবনতি ঘটানোর ও চেষ্টা করছে ফ্যাসিষ্ট এবং তাদের দোসররা।এসবের জন্য অর্থের যোগান দেয়া হয় দেশ ও প্রবাস থেকে।গত ২৬ শে জুলাই বিবিসি বাংলা গন অভ্যুথ্থানে পুলিশের এস আই সন্তোস চৌধুরী নিহতের ঘটনায় এক সংবাদ প্রকাশ করে।বিবিসি বাংলার সংবাদকে একপেশে সংবাদ মনে করে প্রতিবাদে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন মানব বন্ধন করে।
শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে,এই মামলার কিছু কিছু আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালে ও পুলিশ তাদের চোখে দেখেনা।মামলার তদন্তে ধীরগতি নিয়ে অসন্তোস প্রকাশ করেন শহীদ পরিবার।আসামী গ্রেফতারে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।আসামী গ্রেফতার ও তদন্তকাজে ধীর গতি থাকায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকা প্রকাশ করেন বাদী মো:ছানু মিয়া।দ্রুত বিচার আইনে এই মামলায় অপরাধীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবি জানান সকল শহীদ পরিবার।
বানিয়াচং উপজেলা বিএনপি সাংগঠনিক সম্পাদক মো:খালেদ মিয়া বলেন, ৫ ই আগষ্ট বানিয়াচংবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয় কীভাবে একটি যৌক্তিক গন আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে নিরস্ত্র জনতার উপর সশস্ত্র হামলা করেছে ছাত্রলীগ,যুবলীগ,আ,লীগের নেতা-কর্মী।সেদিন বানিয়াচংয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ বানিয়াচংয়ে নয়জন মানুষের জীবন অকালে ঝরে যায়।বুলেটবিদ্ধ হয়ে এখনো কাতরাচ্ছেন শত মানুষ।এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসি গোলাম মোস্তফা বলেন,আসামীদের গ্রেফতারে আমাদের অভিযান চলমান।ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ সহ সকল তথ্য প্রমান সংগ্রহ করছি আমরা।মামলার তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে।
Leave a Reply