ইরানের প্রতিশোধে তছনছ ইসরায়েল, আতঙ্ক-উদ্বেগে বিশ্ব যেন রণক্ষেত্র

ইরানের প্রতিশোধে তছনছ ইসরায়েল, আতঙ্ক-উদ্বেগে বিশ্ব যেন রণক্ষেত্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে এই যুদ্ধে উভয়পক্ষ হামলা ও পাল্টা হামলা চালাচ্ছে, তা পুরো যুদ্ধে পরিণত হওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। ইরান এমনভাবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ ভেদ করে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানিয়েছে, যা ইসরায়েলের জন্য গভীর ক্ষতি এবং ধ্বংসের কারণ হয়েছে। বহু ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে, কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, দেশটি ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন এবং কঠিন সময় পার করছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো শীঘ্রই যুদ্ধ বন্ধ হবে।

ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা শনিবার রাতভর ইরানের ৮০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালিয়েছে এবং তিন দিনে ৭২০টি সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করেছে। এর মধ্যে ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের শীর্ষ কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা নিহত হয়েছেন। তবে ইসরায়েলের কোনো সামরিক বা প্রশাসনিক স্থাপনায় ইরানের হামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।

বিবিসি, সিএনএন ও আল জাজিরা ইসরায়েলের বিধ্বস্ত ভবনগুলোর ছবি প্রকাশ করেছে, যা দেখলে ভয়াবহতা বোঝা যায়। তেহরানের আকাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল। তেহরানের পশ্চিমাঞ্চলে একাধিক আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স জানিয়েছে, হামলা অব্যাহত আছে, ইরানও পাল্টা হামলা চালাচ্ছে।

তবে ইসরায়েলের মিডিয়া অনেক সময় প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি প্রকাশ করে না। যা তথ্য বেরিয়েছে, তাতে ইসরায়েলের কেন্দ্রস্থল তেল আবিবে বহু আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে এবং বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে।

ইরানেও তেলের ডিপোসহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন লেগেছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাদের অনেক স্থানে আগুন লেগেছে। সেখানে স্থানীয়রা বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন।

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ ভেদ করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যা আগে অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ছিল। এই সংঘাতের শুরুতেই ইরান ও ইসরায়েল দুপক্ষই তছনছ হয়েছে।

তবে ইসরায়েল বারবার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, তারা ‘তেহরানকে জ্বালিয়ে দেবে’। ইরানও পাল্টা হুমকি দিচ্ছে, তবে তাদের সামরিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে যেসব শীর্ষ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল পারমাণবিক স্থাপনা, তেলক্ষেত্র ও ডিপোতে হামলা চালিয়েছে। ইরান বলছে, ইসরায়েল হামলা বন্ধ করলে তারা বিরত থাকবে।

এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করছে ইরান, যদিও মার্কিন প্রশাসন তা অস্বীকার করছে। মুসলিম বিশ্ব এই সংঘাতে নীরব, আর পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনে ইসরায়েল একা লড়াই করছে। তবে তৃতীয় দিনে ইয়েমেন ইরানের পক্ষে এসে ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। ইয়েমেনের হুতিদের লক্ষ্য করে ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হুতিদের সামরিক প্রধান মুহাম্মদ আল-ঘামারিকে তারা নিশানা করেছে, তবে তার কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

এই যুদ্ধের তীব্রতায় ইরান ও ইসরায়েলে কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

শনিবার রাতে হামলা-পাল্টা হামলা তীব্রতর হয়, এতে বহু প্রাণহানি হয় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনিশ্চয়তায় পড়ে। এটি শুধু দুটি দেশের দ্বন্দ্ব নয়, পুরো মুসলিম বিশ্ব, পশ্চিমা শক্তি ও বৈশ্বিক কূটনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

হোয়াইট হাউস ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, এই লড়াই সপ্তাহ ব্যাপী চলবে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ভিডিও বার্তায় বলেছেন, তারা আউলু খামেনির শাসন ব্যবস্থা ও লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরানও হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, তেহরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরসহ অনেক স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরানি সংবাদমাধ্যম বলেছে, প্রশাসনিক ভবনে সামান্য ক্ষতি হয়েছে।

ইসরায়েল সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্র ও সাহারান তেল ডিপোতে হামলা চালিয়েছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র। সেখানে আগুন লেগেছে। হাইফায় তেল শোধনাগারেও আগুন দেখা গেছে, তবে তেহরান দাবি করেছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ রেজা জাফরঘান্ড জানিয়েছেন, হামলায় নিহত ও আহতের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। তবে স্পষ্ট পরিসংখ্যান দেওয়া হয়নি। ইসরায়েল অভিযোগ করেছে, ইরান বেসামরিক স্থাপনায় হামলা করেছে।

সিএনএনের টিম ইসরায়েলের বাত ইয়াম শহর পরিদর্শন করে জানিয়েছে, সেখানে বহু আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে এবং নিহত ও নিখোঁজদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ইসরায়েল নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছে।

তেহরানের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উত্তর ও কাস্পিয়ান সাগরের দিকে পালাতে শুরু করেছে। এতে রাস্তায় ভয়াবহ জ্যাম তৈরি হয়েছে। একজন বলেন, ছোট বাচ্চা ও বৃদ্ধকে নিয়ে তাদের সরে যেতে হচ্ছে, যদিও তারা যেতে চান না।

ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজাক হারজগ ‘অপরাধমূলক ইরানি হামলা’ বলে এটিকে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন। শোকের মুহূর্তে পুরো জাতি একসঙ্গে দাঁড়িয়েছে।

ইসরায়েল তেহরানের আকাশসীমা পুরো নিয়ন্ত্রণের দাবি করছে এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছে, আরও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লে ‘তেহরান জ্বলবে’। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ বলেছেন, খুব শিগগিরই তেহরানের আকাশে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান দেখা যাবে।

সেই সঙ্গে তেহরানের কঙ্গান বন্দরে গ্যাস শোধনাগারে বিস্ফোরণ ঘটেছে, যা ইসরায়েলি ড্রোন হামলার ফল বলে দাবি করা হচ্ছে।

তেহরানে সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা অব্যাহত আছে, ইরান পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে, কিছু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করছে। তেহরানের তেল ডিপো ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে হামলার খবর নিশ্চিত হয়েছে।

ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েলের ওপর তারা নতুন ধরনের ‘হাজ কাসেম’ নামের গাইডেড ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা উন্নত প্রযুক্তির এবং মিসাইল ডিফেন্স ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম।

ইরানের এই ক্ষেপণাস্ত্রটির নাম কাসেম সোলাইমানির নামে, যিনি ২০২০ সালে মার্কিন হামলায় নিহত হন।

ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক লক্ষ্য স্থাপন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তাদের শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যার পর, ইরানের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পারমাণবিক কূটনীতিক অ্যালান আইয়ার বলছেন, ইরানের সামরিক বিকল্প সীমিত। তারা কূটনৈতিক পথও নিতে পারে, কিন্তু মিত্রের সংখ্যা কম। ইসরায়েল নিজের লক্ষ্য পূরণে দৃঢ়। ইরানের সবচেয়ে সম্ভাব্য কৌশল হলো ধৈর্য ধরে প্রতিশোধ নেওয়া এবং ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথ বেছে নেওয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই। তবে, যদি ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ‘অভূতপূর্ব শক্তিতে’ পাল্টা জবাব দেবে। একই সঙ্গে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার আশাও প্রকাশ করেছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে হরমুজ প্রণালী হবে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকা। ইরান জানে, তাদের জ্বালানি অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু হলে, তারা এই গুরুত্বপূর্ণ প্রণালীটি বন্ধ করে দিতে পারে।

হরমুজ প্রণালী আন্তর্জাতিক জলপথের অন্যতম সংকীর্ণ স্থান। এর সর্বনিম্ন প্রশস্ততা মাত্র ২১ মাইল, তবে প্রধান শিপিং লাইনের প্রশস্ততা মাত্র ১.৮৬ মাইল। এই সংকীর্ণতা কারণে, এক বা দুইটি তেল ট্যাংকার ডুবিয়ে দিলে পুরো প্রণালী বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহের জন্য হরমুজ প্রণালীর গুরুত্ব অপরিসীম। যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের প্রায় ১৮ শতাংশ এখানে দিয়ে আমদানি হয়। এছাড়া এশিয়ার ৭৬ শতাংশ জ্বালানি পণ্য এই প্রণালীর মাধ্যমে যায়।

এ কারণে, যদি এই জলপথ বন্ধ হয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহের ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটবে। তেলের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেবে।

ওমানে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর প্রণালীর নিরাপত্তা রক্ষা করতে নজরদারি চালাচ্ছে। তবুও, বর্তমান উত্তেজনায় হরমুজ প্রণালী বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।

বর্তমান যুদ্ধের পরিস্থিতি বিবেচনায়, বিশেষজ্ঞদের মতে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এটি সংঘাতকে আরো বৃহত্তর এবং জটিল করে তুলবে। বিশ্ব এই সংঘাতের প্রভাব অনিবার্যভাবেই বহন করবে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.




© All rights reserved ©ekusheysylhet.com
Design BY DHAKA-HOST-BD
weeefff