ভোট দিয়েছিলেন ২০ লাখ কবরবাসী!

ভোট দিয়েছিলেন ২০ লাখ কবরবাসী!

একুশে সিলেট ডেস্ক

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে ২০ লাখের বেশি মৃত ব্যক্তি ভোট দিয়েছেন। এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ মদতপুষ্ট তিন কমিশন। যে কারণে তারা ভোটার তালিকা থেকে মৃত ব্যক্তিদের বাদ দেয়নি। এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে দৈনিক আমার দেশ।

বিষয়টি নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিন বলেছেন, ‘ওরা কবরবাসী ভোটার। কবর থেকে এসে ভোট দিয়েছেন।’

দশম, একাদশ ও দ্বাদশ— এই তিন নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি দেশের ১২ কোটির বেশি ভোটার, যার মধ্যে নতুন সাড়ে চার কোটি। যে কারণে তিনটি নির্বাচনই ‘ভুয়া’ হিসেবে বিতর্কিত। ওই নির্বাচনগুলোয় ভোট দিতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে পুরোনো তালিকার ভোটারদেরও।

তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) আশা করছে, আগামী নির্বাচনে ভোটারদের দীর্ঘদিন ভোট না দিতে পারার আক্ষেপ এবার ঘুচবে। ইসির বলছে, ‘নতুন-পুরোনো সব ভোটারই এবার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। তাদের এমন মন্তব্যের পর দেশের নবীন-প্রবীণ ভোটাররা ভোট দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।

গত তিন নির্বাচনে জীবিত ভোটারদের সরব উপস্থিতিও কম ছিল। তবে মৃত ব্যক্তিদের পক্ষ হয়ে ভোট দিতে সরগরম ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও দোসররা। আর এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ মদতপুষ্ট তিন কমিশন। তারা ভোটার তালিকা থেকে মৃত ব্যক্তিদেরও বাদ দেয়নি; যার সংখ্যা ২০ লাখের বেশি।

এবার সারা দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। হালনাগাদ করা তালিকা থেকে বেরিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক মৃত ভোটারকে বাদ দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

গত ফেব্রুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের কাছে আক্ষেপ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘মৃত ভোটার আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। এর সংখ্যা ২০ লাখের বেশি।’

বর্তমান কমিশন তরুণদের ভোটার করার জন্য দীর্ঘদিন পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে হালনাগাদের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে নতুনদের পাশাপাশি বাদ পড়া অনেক মানুষের সাড়া পাওয়া গেছে। হালনাগাদে তথ্য অনুযায়ী, ৬০ লাখ ভোটারের মধ্যে গত ২৩ মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছে প্রায় ৪৯ লাখ। আগামী ১১ এপ্রিল নিবন্ধন শেষ হবে; বাকি সময়ের মধ্যে ইসির টার্গেট পূরণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত ও মৃত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায় এবার নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন হবে বলে জানিয়েছেন সিইসি নিজেই। ফলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা সরকার গঠন এবং রাজনৈতিক দলের জয়-পরাজয়ে ফ্যাক্টর হবেন, এমনটাই ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দশম ও দ্বাদশ— এ দুটি সংসদ ছিল বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলবিহীন একতরফা নির্বাচন। ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। তবে কমিশন নিজেদের লজ্জা লুকাতে ভোটের হার বাড়িয়ে দায় এড়িয়েছিল। ওই দুটি নির্বাচনে যথাক্রমে ৪০ শতাংশ ও ৪০ দশমিক ৪০ শতাংশ দেখানো হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দশম ও দ্বাদশ সংসদে ৫ শতাংশের বেশি মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রে যাননি।

সাবেক ইসি সচিব জাহাংগীর আলম দ্বাদশ সংসদ-পরবর্তী নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা মঞ্চেই বলে বসেন, ৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। তার এ বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়াসহ সর্বত্র ভাইরাল হয়। এসব তথ্য-উপাত্ত থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ৩২ শতাংশ লোকও ভোট দিতে যাননি।

অন্যদিকে, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনটি সব দিক থেকেই ব্যতিক্রম ছিল। ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করায় আওয়ামী লীগের ভোটাররাও কেন্দ্রে যাননি। পুরো কেন্দ্র ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর দখলে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সমর্থকদের কিছুসংখ্যক সকালে কেন্দ্রে গেলে ফ্যাসিবাদী হাসিনার পেটোয়া পুলিশ বাহিনী জানায়, তাদের ভোটটি আগেই হয়ে গেছে। এ নিয়ে মানুষের আক্ষেপ ছিল ব্যাপক। ভোটারবিহীন এ নির্বাচনেও ভোটের হার দেখানো হয় ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। এ নির্বাচনে কিছু কিছু কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মে (জেন-জি) ভোটারদের মধ্যে এ আগ্রহ বেশি। নির্বাচন কমিশনও বিভিন্ন বক্তব্য ও বিবৃতিতে মানুষকে আশ্বস্ত করছে।

ইসি বলছে, আগামী নির্বাচন হবে উৎসবমুখর। তাই নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সারা দেশের মানুষের তথ্য সংগ্রহ করছেন তারা।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত ভোটার তথ্য হালনাগাদ চলে। সেখানে ফরম পূরণ করেন ৬০ লাখ নাগরিক। ইসির তথ্যমতে, গত ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫০ লাখ ভোটার নিবন্ধিত হয়েছেন, যার মধ্যে বাদ পড়া ৩৫ লাখ ৯৪ হাজার এবং নতুন ১২ লাখ ৮৮ হাজার। নতুন প্রজন্মের এসব নাগরিক ত্রয়োদশ সংসদে ভোট দেবেন।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালে দেশে মোট ভোটার ছিল ১২ কোটি ১৮ লাখ। সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী দেশে মোট ভোটার সংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি, যাদের সবাই ত্রয়োদশ সংসদে ভোট দিতে পারবেন।

তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নবম সংসদের পর থেকে দ্বাদশ সংসদের আগ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ কোটি নতুন ভোটার তালিকায় যোগ হয়। কিন্তু তারা নিজেদের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। পুরোনো ৮ কোটি ভোটারের বেশির ভাগই একতরফা নির্বাচনের কারণে ভোট দেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিলেন। ফলে দেশে ভোটারখরা তৈরি হয়। এমনও দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রগুলোতে মাইকিং করেও ভোটার আনা যায়নি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। রাষ্ট্র থেকে সংবিধান সংস্কারের হিড়িক পড়ে। নির্বাচন কমিশনও এর বাইরে নয়। তারাও ভোটের পরিবেশ এবং সবাইকে ভোট ব্যবস্থায় আগ্রহী করতে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর বাড়ি বাড়ি যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বিগত কমিশন বেরিয়ে আসে। বর্তমান কমিশন নতুন প্রজন্মকে ভোটদানে আগ্রহী করতে পুরোনো ধারায় ফেরেন (বাড়ি বাড়ি)।

স্থানীয় সংস্কার কমিশনের আহ্বায়ক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিগত তিনটি নির্বাচন ছিল প্রহসনের। তাই ভোটদানে মানুষের আগ্রহ ছিল না। তবে নির্বাচনব্যবস্থায় নানা সংস্কার ও হালনাগাদের পর নতুন একটি নির্ভুল ভোটার তালিকার মাধ্যমে আশা করা যায় মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্র যাবে। ভোটটি উৎসবমুখর হবে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.




© All rights reserved ©ekusheysylhet.com
Design BY DHAKA-HOST-BD
weeefff