স্টাফ রিপোর্ট
সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর সীমান্ত যেনো চোরাকারবারীদের র্স্বগরাজ্যে পরিণত হয়েছে। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে চোরাকারবারীদের গডফাদার বিএনপি নেতা এসএম শাহীন ও যু্বদল নেতা জমিস উদ্দিন। সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন এই দুই গডফাদারের নেতৃত্বে ভারত থেকে আসছে অস্ত্র, মাদকসহ অন্যান্য চোরাচালান পণ্য। সিলেটের যে কোনও সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা তাদের মালামাল আটক করলে তা হামলা করে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় শাহীন ও জসিম গ্রুপের সদস্যরা। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য পাঠাচ্ছে শাহীন-জসিম। মাঝে মধ্যে প্রশাসন অভিযান করে তাদের লোক আটক করলে থানা থেকেই ছাড়িয়ে নিয়ে যায় তারা। এতো অপকর্মের পরও ধরাছোঁয়ার বাহিরে রয়েছে ‘গডফাদার’ এসএম শাহীন ও জমিস উদ্দিন। সীমান্তের আতঙ্ক এই দুই বিএনপি ও যুবদল নেতার চাঁদাবাজী, লুটপাট ও হামলার শিকার হয়েছে খোদ বিজিবির সদস্যরা। বিএনপি ও যুবদলের নাম ভাঙিয়ে তারা তাদের রামরাজত্ব কায়েম করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এসএম শাহীন আহমদ গোয়াইনঘাট উপজেলার ২নং পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এবং জসিম উদ্দিন ২নং পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের যুবদলের সভাপতি প্রার্থী।
সম্প্রতি ৫ আগস্টের পর গণমাধ্যমে বিএনপি নেতা এসএম শাহীন ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিনের ‘রামরাজত্ব’ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন তারা। ছোটখাটো ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা পার না পেলেও রহস্যজনক কারণে বিএনপি নেতা এসএম শাহীন ও জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি সিলেট বিএনপি ও যুবদলের শীর্ষ নেতারা!
ঘটনা-১
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গোয়াইনঘাটের সোনারহাট বিজিবি ক্যাম্পে সীমান্তের গডফাদার বিএনপি নেতা শাহীন ও যুবদল নেতা জসিমের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে ১৪ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এসময় লুটপাট ঠেকাতে বিজিবি পাল্টা গুলি চালালে ৩ ব্যক্তি নিহত হন। এই ঘটনায় বিজিবি’র হাবিলদার রহিদুল ইসলাম বাদি হয়ে গোয়াইনঘাট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তবে এখনো পর্যন্ত থানাপুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি। উল্টো এই দুই চোরকারাবারী থানায় গিয়ে পুলিশি কাজে বাধা দিচ্ছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
ঘটনা-২
১২ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫টা। ভারতের ভেতর থেকে বাংলাদেশে অবৈধ চোরচালানের পণ্য ঢুকছে খবর পায় বিজিবি’র একটি বিশেষ টহল দল। খবর পেয়ে সুবেদার আবদুল মুমিনের নেতৃত্বে একদল বিজিবি সদস্য গোয়াইনঘাটের সদর ইউনিয়নে ননীগ্রামে অভিযান পরিচালনা করে ২৫শ কেজি ভারত থেকে আসা অবৈধ চিনি জব্দ করেন। চিনি আটকের খবর পেয়ে সীমান্তের গডফার বিএনপি নেতা এসএম শাহীন ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের সশন্ত্র বাহিনী বিজিবি সদস্যের উপর হামলা চালিয়ে জব্দকৃত ২৫শ কেজি চিনি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় যুবদল নেতা জসিম উদ্দিনকে প্রধান আসামি করে গোয়াইনঘাট থানায় মামলা দায়ের করেন বিজিবি’র পান্তুমাই বিওপির সুবেদার আবদুল মোমেন।
ঘটনা-৩
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪। রাত সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ রণক্ষেত্রে পরিণিত হয় গোয়াইনঘাটের পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের হাজীপুর বাজার। বিএনপি নেতা এসএম শাহীন ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী চাঁদাবাজী করতে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে সংঘর্ষ বাধে। ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষে অর্ধ শতাধিক স্থানীয় সাধারণ ব্যবসায়ী আহত হন। তবে একপর্যায়ে গণধোইয়ের শিকার হন শাহীন ও জসিমসহ তার বাহিনীর অন্য সদস্যরা। এ ঘটনায় গোয়াইনঘাটের ব্যবসায়ী আবুল হাসেম যুবদল নেতা জসিম উদ্দিনকে প্রধান আসামি করে ২৩ জনকে আসামি করে একটি চাঁদাবাজী মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন ১১ দিন কারাভোগ করেন।
ঘটনা-৪
১৬ মার্চ ২০২৫ রাত ১০টা। গোয়াইনঘাটের সীমান্তবর্তী নিজপাট ইউনিয়নের টিপরাখলা সীমান্তে বিজিবি টহল দলের উপর বিএনপি নেতা এসএম শাহীন ও যুবদল নেতা জসিমের সন্ত্রাসী বাহিনী হামলা চালায় বিজিবি সদস্যদের উপর। এসময় দুই বিজিবি সদস্য আহত হন। এই হামলার ঘটনায় সীমান্তের গডফাদার শাহীন ও জসিমসহ তার বাহিনীর উপর মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জৈন্তাপুর থানা সূত্রে জানা গেছে। তবে মামলা থেকে বাঁচতে নানা কৌশল অবলম্বন করছে এই দুই শীর্ষ চোরাকারবারি।
ঘটনা-৫
১১ মার্চ ২০২৫। গোয়াইনঘাট সীমান্তে সিলেটের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চালান জব্দ করে বিজিবি। বিজিবি সদস্যরা লামাপুঞ্জি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এই চালান আটকের পর জব্দ করে। মাদক, চিনি, কসমেটিক্সসহ বিভিন্ন ধরণের চোরাচালান পণ্য জব্দ করা হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই ২১ কোটি টাকার চোরাচালান জব্দের পর বেপরোয়া হয়ে উঠে সীমান্তের গডফাদার খ্যাত শাহীন ও জসিম। শাহীন ও জসিমের দিনভর নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পর ১২ কোটি টাকার চোরাচালান জব্দের কথা মিডিয়া আসে। তবে এর একদিন পরই বিজিবি সংবাদ মাধ্যমে আরেকটি প্রেস রিলিজ প্রদান করে। সেখানে ১২ নয় ২১ কোটি টাকার চোরাচালান জব্দ হয়েছে বলে জানানো হয়। তবে স্থানীয়রা জানান, এই ২১ কোটি টাকার চোরাচালান ছিল এসএম শাহীন ও জসিম উদ্দিনের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিএনপি নেতা জানান, যারা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে, যারা মানুষের শান্তি নষ্ট করবে তাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, আগামীর দেশনায়ক তারেক রহমান ইতোমধ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দিয়ে বলেছেন, বিএনপি হলো ভালো মানুষের দল। এ দলে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজদের কোনো স্থান নেই। বিএনপি করতে হলে মানুষের সঙ্গে সংযোগ রাখতে হবে। মানুষ যাকে ভালো না বাসবে, তার স্থান বিএনপিতে হবে না।
তারা আরো বলেন, বিএনপি নেতা এসএম শাহীন ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা একাধিক মামলার আসামি। গোয়াইনঘাটে রামরাজস্ব কায়েম করছে। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর এবং চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরও কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিএনপির তৃণমূল নেতারা বিষ্মিত। আমরা জেলা বিএনপি ও যুবদলের শীর্ষ নেতাদের নিকট আবেদন করব সীমান্তের গডফাদার শাহীন ও জসিমের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি প্রদান করে বিএনপির ভাবমুর্তি রক্ষা করুন।
এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা এসএম শাহীন ও যুবদল নেতা জসিম উদ্দিনের মুঠোফোন রাত ২টায় একাধিকবার কল দিলে তারা ফোন রিসিভ করেন নি।
গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার তোফায়েল আহমদ জানান, চোরাকারবারেদের ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানা-পুলিশ জিরো টলারেন্সে আছে। শাহীন ও জসিমকে আমারা খুঁজছি।
সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মো. মকসুদ আহমদ জানান, বিএনপি বা যুবদলের নাম ভাঙিয়ে কেউ কোনো অপর্কম করলে এর দায় সংগঠন দিবে না। যদি যুবদলের কোন পদবীদারী নেতা এসব অপকর্মের সাথে সংযুক্ত থাকেন এবং আমরা তথ্য সঠিক পাই তবে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিলেট জেলা যুবদলের সভাপতি অ্যাডভোকেট মুমিনুল ইসলাম মুমিন জানান, বিএনপি ও যুবদল নেতা এসএম শাহীন ও জসিমের উপর এর আগে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর আমরা তাদের ঢেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলাম। তাদের সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। আমাদের পরিষ্কার বার্তা দলের নাম ভাঙিয়ে যারাই অপকর্ম করবে তাদের কোন প্রশয় দেওয়া হবে না। যদি আমার এসব কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা পাই তাহলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply